দুই বোন --- পৃষ্ঠা-২২

Submitted by administrator on Fri, 04/27/2012 - 01:04
দুই বোন বের করে তার উপরে মাথা গুঁজে বসে। তখন শশাঙ্কর পালা। বইগুলো টেনে নিয়ে পুনরায় বাক্সজাত করে সেই বাক্সর উপর সে চেপে বসে। ঊর্মি বলে, “শশাঙ্কদা, ভারি অন্যায়। আমার সময় নষ্ট কোরো না।”

শশাঙ্ক বলে, “তোমার সময় নষ্ট করতে গেলে আমারও সময় নষ্ট। অতএব শোধ-বোধ।”

তার পরে খানিকক্ষণ কাড়াকাড়ির চেষ্টা করে অবশেষে ঊর্মি হার মানে। সেটা যে ওর পক্ষে নিতান্ত আপত্তিজনক তা মনে হয় না। এইরকম বাধা পেলেও কর্তব্যবুদ্ধির পীড়ন দিন পাঁচ-ছয় একাদিক্রমে চলে, তার পরে আবার তার জোর কমে যায়। বলে, “শশাঙ্কদা, আমাকে দুর্বল মনে কোরো না। মনের মধ্যে প্রতিজ্ঞা দৃঢ় করেই রেখেছি।”

“অর্থাৎ?”

“অর্থাৎ, এখানে ডিগ্রি নিয়ে য়ুরোপে যাব ডাক্তারি শিখতে।”

“তার পরে?”

“তার পরে হাঁসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তার ভার নেব।”

“আর কার ভার নেবে। ঐ-যে নীরদ মুখুজ্জে বলে একটা ইনসাফারেব্‌ল্‌--”

শশাঙ্কের মুখ চাপা দিয়ে ঊর্মি বলে, “চুপ করো। এই-সব কথা বল যদি তোমার সঙ্গে একেবারে ঝগড়া হয়ে যাবে।”

নিজেকে ঊর্মি খুব কঠিন করে বলে, ‘সত্য হতে হবে আমাকে, সত্য হতে হবে।’ নীরদের সঙ্গে ওর যে সম্বন্ধ বাবা স্বয়ং স্থির করে দিয়েছেন তার প্রতি খাঁটি না হতে পারাকে ও অসতীত্ব বলে মনে করে।

কিন্তু মুশকিল এই যে, অপর পক্ষ থেকে কোনো জোর পায় না। ঊর্মি যেন এমন একটি গাছ যা মাটিকে আঁকড়ে আছে, কিন্তু আকাশের আলো থেকে বঞ্চিত, পাতাগুলো পাণ্ডুবর্ণ হয়ে আসে। এক-এক সময় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে; মনে মনে ভাবে, এ মানুষটা চিঠির মতো চিঠি লিখতে পারে না কেন।

ঊর্মি অনেক কাল কন্‌ভেণ্টে পড়েছে। আর-কিছু না হোক ইংরেজিতে ওর বিদ্যে পাকা। সে কথা নীরদের জানা ছিল। সেইজন্যেই, ইংরেজি লিখে নীরদ ওকে অভিভূত করবে এই ছিল তার পণ। বাংলায় চিঠি লিখলে বিপদ বাঁচত, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে বেচারা জানে না যে সে ইংরেজি জানে না। ভারী ভারী শব্দ জুটিয়ে এনে, পুঁথিগত দীর্ঘপ্রস্থ বচন যোজনা ক’রে, ওর বাক্যগুলোকে করে তুলত বস্তা-বোঝাই গোরুর গাড়ির মতো। ঊর্মির হাসি আসত, কিন্তু হাসতে সে লজ্জা পেত; নিজেকে তিরস্কার করে বলত, বাঙালির ইংরেজিতে ত্রুটি হলে তা নিয়ে দোষ ধরা স্নবিশ।

দেশে থাকতে মোকাবিলায় যখন নীরদ ক্ষণে ক্ষণে সদুপদেশ দিয়েছে তখন ওর রকম-সকমে সেগুলো গভীর হয়ে উঠেছে গৌরবে। যতটা কানে শোনা যেত তার চেয়ে আন্দাজে তার ওজন হত বেশি। কিন্তু লম্বা চিঠিতে আন্দাজের জায়গা থাকে না। কোমর-বাঁধা ভারী ভারী কথা হালকা হয়ে যায়, মোটা মোটা আওয়াজেই ধরা পড়ে বলবার বিষয়ের কম্‌তি।

নীরদের যে ভাবটা কাছে থাকতে ও সয়ে গিয়েছিল সেইটে দূরের থেকে ওকে সব চেয়ে বাজে। লোকটা একেবারেই হাসতে জানে না। চিঠিতে সব চেয়ে প্রকাশ পায় সেই অভাবটা। এই নিয়ে শশাঙ্কের সঙ্গে তুলনা ওর মনে আপনিই এসে পড়ে।

তুলনার একটা উপলক্ষ এই সেদিন হঠাৎ ঘটেছে। কাপড় খুঁজতে গিয়ে বাক্সের তলা থেকে বেরোল পশমের বোনা একপাটি অসমাপ্ত জুতো। মনে পড়ে গেল চার বছর আগেকার কথা। তখন হেমন্ত ছিল বেঁচে। ওরা সকলে মিলে গিয়েছিল দার্জিলিঙে। আমোদের অন্ত ছিল না। হেমন্তে আর শশাঙ্কে মিলে ঠাট্টাতামাশার পাগলা -ঝোরা বইয়ে দিয়েছিল। ঊর্মি তার এক মাসির কাছ থেকে পশমের কাজ নতুন শিখেছে। জন্মদিনে দাদাকে দেবে বলে একজোড়া জুতো বুনছিল। তা নিয়ে শশাঙ্ক ওকে কেবলই ঠাট্টা করত; বলত “দাদাকে আর যাই দাও, জুতো নয়। ভগবান মনু বলেছেন ওতে গুরুজনের অসম্মান হয়।”

Related Items

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-২০

দুই বোন

শশাঙ্ক বলে, “আহা ছেলেমানুষ, এখানে ওর সঙ্গী নেই কেউ, একটু খেলাধূলা না পেলে বাঁচবে কেন।”

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-১৯

সবুর করে সেটাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠবার মতো চাঞ্চল্য দেখা যায় না। সন্ধ্যাবেলায় রেডিয়োর কাছে কান পাতবার জন্যে শশাঙ্ক মজুমদারের উৎসাহ এত কাল অনভিব্যক্ত ছিল। আজকাল ঊর্মি যখন তাকে টেনে আনে তখন ব্যাপারটাকে তুচ্ছ এবং সময়টাকে ব্যর্থ মনে হয় না। এরোপ্লেন-ওড়া দেখবার জন্যে একদিন ভোরবেলা দমদম পর্যন্ত যেতে হল, বৈজ্ঞ

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-১৮

তো ওর মনে নেই--সেই চিন্তার সূত্রটি আছে ওর দিদির মধ্যে। তাই ওর কাছে এই কাজগুলো খেলা, একরকম ছুটি, উদ্দেশ্যবিবর্জিত উদ্‌যোগ। ও যেখানে এত দিন ছিল এ তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জগৎ। এখানে ওর সম্মুখে কোনো লক্ষ্য তর্জনী তুলে নেই; অথচ দিনগুলো কাজ দিয়ে পূর্ণ, সে কাজ বিচিত্র। ভুল হয়, ত্রুটি হয়, তার জন্যে ক