দুই বোন --- পৃষ্ঠা-২১

Submitted by administrator on Fri, 04/27/2012 - 01:03

শশাঙ্কের আহারবিহার বেশবাসের চিরাচরিত ব্যবস্থায় নানারকম ত্রুটি হচ্ছে সন্দেহ নেই। যে পথ্যটা তার বিশেষ রুচিকর সেটাই খাবার সময় হঠাৎ দেখা যায় অবর্তমান। তার কৈফিয়ত মেলে, কিন্তু কোনো কৈফিয়তকে এ সংসার এত দিন আমল দেয় নি। এ-সব অনবধানতা ছিল অমার্জনীয়, কঠোর শাসনের যোগ্য; সেই বিধিবদ্ধ সংসারে আজ এত বড়ো যুগান্তর ঘটেছে যে, গুরুতর ত্রুটিগুলোও প্রহসনের মতো হয়ে উঠল। দোষ দেবে কাকে! দিদির নির্দেশমত ঊর্মি যখন রান্নাঘরে বেতের মোড়ার উপর বসে পাকপ্রণালীর পরিচালনকার্যে নিযুক্ত, সঙ্গে সঙ্গে পাচক-ঠাকরুনের পূর্বজীবনের বিবরণগুলির পর্যালোচনাও চলছে, এমন সময় শশাঙ্ক হঠাৎ এসে বলে, “ও-সব এখন থাক্‌।”

“কেন, কী করতে হবে?”

“আমার এ বেলা ছুটি আছে, চলো, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বিলডিংটা দেখবে। ওটার গুমর দেখলে হাসি পায় কেন তোমাকে বুঝিয়ে দেব।”

এত বড়ো প্রলোভনে কর্তব্যে ফাঁকি দিতে ঊর্মির মনও তৎক্ষণাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। শর্মিলা জানে পাকশালা থেকে তার সহোদরার অন্তর্ধান আহার্যের উৎকর্ষ-সাধনে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না, তবু স্নিগ্ধ হৃদয়ের যত্নটুকু শশাঙ্কের আরামকে অলংকৃত করে। কিন্তু আরামের কথা তুলে কী হবে যখন প্রতিদিনই স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে আরামটা সামান্য হয়ে গেছে, স্বামী হয়েছে খুশি।

এই দিক থেকে শর্মিলারে মনে এল অশান্তি। রোগশয্যার এ-পাশ ও-পাশ ফিরতে ফিরতে নিজেকে বার বার করে বলছে, ‘মরবার আগে ওই কথাটুকু বুঝে গেলুম। আর সবই করেছি, কেবল খুশি করতে পারি নি। ভেবেছিলুম ঊর্মিমালার মধ্যে নিজেকেই দেখতে পাব, কিন্তু ও তো আমি নয়, ও যে সম্পূর্ণ আর-এক মেয়ে।’ জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, ‘আমার জায়গা ও নেয় নি, ওর জায়গা আমি নিতে পারব না। আমি চলে গেলে ক্ষতি হবে, কিন্তু ও চলে গেলে সব শূন্য হবে।’

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল-- শীতের দিন আসছে, গরম কাপড়গুলো রোদ্‌দুরে দেওয়া চাই। ঊর্মি তখন শশাঙ্কের সঙ্গে পিংপং খেলছিল, ডেকে পাঠালে।

বললে, “ঊর্মি, এই নে চাবি। গরম কাপড়গুলো ছাদের উপর রোদে মেলে দে গে।”

ঊর্মি আলমারিতে চাবি সবেমাত্র লাগিয়েছে এমন সময় শশাঙ্ক এসে বললে, “ও-সব পরে হবে, ঢের সময় আছে। খেলাটা শেষ করে যাও।”

“কিন্তু দিদি--”

“আচ্ছা, দিদির কাছে ছুটি নিয়ে আসছি।”

দিদি ছুটি দিলে, সেইসঙ্গে বড়ো একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। দাসীকে ডেকে বললে, “দে তো আমার মাথায় ঠাণ্ডা জলের পটি।”

যদিও অনেক দিন পরে হঠাৎ ঊর্মি ছাড়া পেয়ে যেন আত্মবিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল, তবু সহসা এক-এক দিন মনে পড়ত ওর জীবনের কঠিন দায়িত্ব। ও তো স্বাধীন নয়, ও যে বাঁধা ওর ব্রতের সঙ্গে। তারই সঙ্গে মিলিয়ে যে বাঁধন ওকে ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে বেঁধেছে তার অনুশাসন আছে ওর ‘পরে। ওর দৈনিক কর্তব্যের খুঁটিনাটি সেই তো স্থির করে দিয়েছে। ওর জীবনের ‘পরে তার চিরকালের অধিকার, এ কথা ঊর্মি কোনোমতে অস্বীকার করতে পারে না। যখন নীরদ উপস্থিত ছিল স্বীকার করা সহজ ছিল, জোর পেত মনে। এখন ওর ইচ্ছে একেবারেই বিমুখ হয়ে গেছে, অথচ কর্তব্যবুদ্ধি তাড়া দিচ্ছে। কর্তব্যবুদ্ধির অত্যাচারেই মন আরো যাচ্ছে বিগড়িয়ে। নিজের অপরাধ ক্ষমা করা কঠিন হয়ে উঠল বলেই অপরাধ প্রশ্রয় পেতে লাগল। বেদনায় আফিমের প্রলেপ দেবার জন্যে শশাঙ্কের সঙ্গে খেলায় আমোদে নিজেকে সর্বক্ষণ ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। বলে, যখন সময় আসবে তখন আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে, এখন যে-কয়দিন ছুটি ও-সব কথা থাক্‌। আবার হঠাৎ এক -এক দিন মাথা ঝাঁকানি দিয়ে বই- খাতা ট্রাঙ্কের থেকে

Related Items

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৯

  কিন্তু ব্যবহারে করে নি যে তার কারণ, এ ক্ষেত্রে যথোচিত ব্যবহারটাই ওর স্বভাবে নেই। ও আলোচনা করতে পারে, আলাপ করতে জানে না। যৌবনের উত্তাপ ওর মধ্যে যদি-বা থাকে, তার আলোটা নেই। এইজন্যেই, যে-সব যুবকের মধ্যে যৌবনটা যথেষ্ট প্রকাশমান তাদের অবজ্ঞা করেই ও আত্মপ্রসাদ লাভ করে। এই-সকল কারণে ওকে ঊর্মির উমেদার-শ্রেণীতে গণ্য করতে কেউ সাহস করে নি। অথচ সেই প্রতীয়মান নিরাসক্তিই বর্তমান কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওর ‘পরে ঊর্মির শ্রদ্ধাকে সম্ভ্রমের সীমায় টেনে এনেছিল।

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৮

ঊর্মির অকস্মাৎ মনে হল, এ মানুষটার প্রতিভা অসামান্য। বাবাকে বললে, “দেখো তো বাবা, অল্প বয়স অথচ নিজের পরে কী দৃঢ় বিশ্বাস আর অতবড়ো হাড়-চওড়া বিলিতি ডাক্তারের মতের বিরুদ্ধে নিজের মতকে নিঃসংশয়ে প্রচার করতে পারে এমন অসংকুচিত সাহস।”

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৬

তেলা কাগজ কিম্বা খাতাপত্র নিয়ে বসে। তবু সাবেক কালের নিয়ম চলছে। মোটা গদিওআলা সোফার সামনে প্রস্তুত থাকে পশমের চটিজোড়া। সেখানে পানের বাটায় আগেকার মতোই পান থাকে সাজা, আলনায় থাকে পাতলা সিল্কের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি। আপিস-ঘরটাতে হস্তক্ষেপ করতে সাহসের দরকার, তবু শশাঙ্কের অনুপস্থিতি-কালে ঝাড়ন হাতে শর্মি

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৫

মেরামত করতে। শর্মিলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। বাষ্পাকুলকণ্ঠে বললে, “গাড়ি তুমি নিজে হাঁকাতে পারবে না।”

শশাঙ্ক হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললে, “পরের হাতের আপদও একই জাতের দুশমন।”

দুই বোন --- পৃষ্ঠা-৪

“সে কি হয়। ও টাকা যে তোমার।” বলে শশাঙ্ক উঠে পড়ল। বাইরে লোক বসে আছে।

শর্মিলা স্বামীর কাপড় টেনে বসিয়ে বললে, “আমিও যে তোমারই।” তার পর বললে, “বের করো তোমার জেব থেকে ফাউণ্টেন্‌পেন, এই নাও চিঠির কাগজ, লেখো রেজিগ্‌নেশন-পত্র। সেটা ডাকে রওনা না করে আমার শান্তি নেই।”