রেগুলেটিং আইন, পিটস আইন ও সনদ আইন

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 05/08/2013 - 15:49

রেগুলেটিং আইন (Regulating Act of 1773)

দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের কয়েক বছর পর ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস হয়েছিল । কোম্পানির হাত থেকে ক্ষমতা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে নেওয়ার এটিই ছিল প্রথম পদক্ষেপ । কোম্পানির নায়েব-দেওয়ান ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের বল্গাহীন ও অবাধ শোষণের ফলে সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের জন্য কোম্পানিকে দায়ী করে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির স্বেচ্ছাচারী কর্মচারীদের বরখাস্ত করতে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস হয়েছিল । এই আইনে তিনটি দিক ঠিক হয়েছিল :-

(ক) কোম্পানির অংশীদার ও পরিচালকদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করা, 

(খ) কোম্পানির উপর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রাধান্য বৃদ্ধি করা, 

(গ) বোম্বে ও মাদ্রাজ কুঠির সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক নির্ণয় করা । এই দুই প্রেসিডেন্সিতে স্ব-পরিষদ থাকলেও এবং বাংলার গভর্নর জেনারেলের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে থেকেও, হেস্টিংসের কাউন্সিল বা উপদেষ্টা পর্ষদের চারজন সদস্যের মধ্যে বারওয়েল ছাড়া বাকি তিনজন যথা— ফিলিপ ফ্রান্সিস, ক্লেভারিব ও জনসন হেস্টিংসবিদ্বেষী ছিলেন । তাঁকে সাহায্য করার জন্য তিনজন বিচারপতি ছিলেন । 

(ঘ) রেগুলেটিং অ্যাক্টে ৫০০ পাউন্ডের পরিবর্তে ১০০০ পাউন্ড শেয়ারহোল্ডারদের ভোটদানের ক্ষমতা প্রদান করা হয় । তিন, ছয় ও দশ হাজার পাউন্ড শেয়ারহোল্ডারদের ভোটদানের ক্ষমতা যথাক্রমে দুই, তিন ও চারটি করে ভোট দানের অধিকার দেওয়া হয় ।

(ঙ) চার বছরের জন্য ডিরেক্টর নির্বাচন হয় ।                

পিটস আইন (Pitt's India Act)

ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির কার্যকলাপের ওপর খুব একটা খুশি ছিলেন না । কোম্পানির ও তার কর্মচারীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল এই পিটস আইনের প্রধান উদ্দেশ্য । ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একাধিকবার আইন প্রণয়ন করে । ১৭৮৪ সালে পিটের ভারত শাসন আইন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য । ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছোটো পিটের (Young Pit) নামানুসারে এই আইনটি রচিত হয় বলে একে পিটস অ্যাক্ট বা পিটস আইন বলা হয় ।

পিটস্‌ আইন অনুসারে:-

১) গভর্নর জেনারেল পরিষদের সদস্য সংখ্যা চার জন থেকে কমিয়ে তিন জন করা হয় ।

২) গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সির ওপর কলকাতা প্রেসিডেন্সির নিয়ন্ত্রন সুদৃঢ় করা হয় ।

৩) জরুরি প্রয়োজনে গভর্নর জেনারেলকে তাঁর পরিষদের মতামতকে অগ্রাহ্য করার অধিকার দেওয়া হয় ।

৪)  ছয় জন কমিশনার নিয়ে বোর্ড অফ কন্ট্রোল নামে একটি পরিষদ গঠিত হয় । 'কোর্ট অফ ডিরেক্টর্স' -এর কাজকর্মের ভার বোর্ড অফ কন্ট্রোলের ওপর অর্পণ করা হয় । 'সিক্রেট কমিটি' বা 'গোপন কমিটি' -এর মাধ্যমে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের কাজকর্ম কোম্পানিকে জানাবার সুযোগ হয় ।  

৫) পিটের ভারত শাসন আইনে বলা হয়েছিল যে, কোম্পানির কর্মচারীগণ চাকরির পর ভারত থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার পর কী পরিমাণ টাকা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন, তার হিসাব দাখিল করতে হবে ।

চার্টার বা সনদ আইন

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কোম্পানির সঠিক অবস্থা নির্ধারণের জন্য চার্টার অ্যাক্ট পাস হয় ।

(ক) এই আইনে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটানো হয় । ফলে ইউরোপের অন্যান্য বণিকদের কাছে ভারতের বাজার উন্মুক্ত হয় ।

(খ) আরও বলা হল, বাণিজ্য ও রাজস্ব খাতের আয়কে কোম্পানি আলাদা করে রাখবে । ওই খাতের অর্থ সামরিক ও বেসামরিক খাতে ব্যয় হবে ।

(গ) ভারতে সাহিত্যের, সাহিত্যিকদের ও বিজ্ঞানচর্চার জন্য সরকার এক লক্ষ টাকা দেবার ব্যবস্থা এই আইনে করা হয় ।

(ঘ) খ্রিস্টান মিশনারিদের ভারতে ধর্মপ্রচারের অনুমতি প্রদান করা হয় ।  

(ঙ) ভারতবর্ষে কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাণিজ্য চার্টার বা সনদ প্রদান করতে থাকে ।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এই সনদ প্রতি কুড়ি বছর অন্তর অন্তর নবীকরণ করতে হত যা ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে ভারতে কোম্পানির কাজকর্মের গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার সুযোগ দিত । একই সঙ্গে প্রতিটি সনদ আইনের মাধ্যমে কোম্পানির বিভিন্ন অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়া বিভিন্ন সনদ আইনের মধ্যে ১৮১৩ এবং ১৮৩৩ সালের সনদ আইন দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

*****

Related Items

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Quit India Movement and the Working Class):-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেয় । এই আন্দো

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (The Civil Disobedience Movement and the Working Class) :-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শ্রমিকরা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে । এই সময় বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন যথেষ্ট শ

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (Workers and Peasants Party) :-

কুতুবুদ্দিন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক হেমন্ত সরকার, সামসুদ্দিন হোসেন প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর বাংলায় 'লেবার স্বরাজ পার্টি অব দা ইন্ডিয়ান

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Non Co-operation Movement and the Working Class):- 

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় সারা ভারতে শ্রমিকরা আন্দোলনে শামিল হয় । এই সময় বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী ওঠে । শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো, ব

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Anti-Partition Movement and the Working Class):-

ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা না করলেও ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত শ্রমিক