ঊনিশ শতকের বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 01/28/2022 - 19:20

প্রশ্ন : ঊনিশ শতকের বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

উঃ- ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্মসমাজের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার যেমন— সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি অমানবিক প্রথার উচ্ছেদ সাধন এবং নারীশিক্ষার প্রসার, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, নারীজাতির সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ।

১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে মতপার্থক্য তৈরি হলে ব্রাহ্মসমাজ তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ।

রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় তাঁর ধর্মমতকে কোনো বিশেষ সম্প্রদায় রূপে গড়ে তুলতে চাননি, কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজকে একটি বিশেষ সম্প্রদায় রূপে গড়ে তোলেন এবং 'ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে 'তত্ত্ববোধিনী সভা' এবং ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে 'তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা' স্থাপিত হয় এবং ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' ।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় নারীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহের পক্ষে এবং বহুবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচার চালান । কিন্তু অচিরেই বেদের অভ্রান্ততা, ব্রাহ্ম আচার্যদের উপবিত ধারণ প্রভৃতি নানা প্রশ্নে মত পার্থক্য তৈরি হলে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ থেকে বহিস্কৃত হয়ে কেশবচন্দ্র সেন ও তার অনুগামীরা 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' প্রতিষ্ঠা করেন । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজ 'আদি ব্রাহ্মসমাজ' নামে পরিচিত হয় ।

কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে সমাজ সংস্কার আন্দোলন উনিশ শতকে এক নতুন মাত্রা পায় এবং তিনি ইন্ডিয়ান মিরর, বামাবোধিনী পত্রিকায় নারীশিক্ষার প্রসার, নারী স্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতির পক্ষে এবং বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচার চালান । নারী কল্যাণের জন্য ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে 'বামাবোধিনী' ও ব্রাহ্মিকা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন । কেশবচন্দ্র সেনের আন্দোলনের চাপে সরকার ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে 'তিন আইন' পাস করে— বাল্য বিবাহ ও বহুবিবাহ রদ, অসবর্ণ বিবাহকে আইন সিদ্ধ করে । ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে 'সঙ্গত সভা' প্রতিষ্ঠা করে নিপীড়িত মানুষের সেবা ও ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন ।

কিন্তু কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টপ্রীতি, চৈতন্যপ্রীতি, গুরুবাদ ও ভক্তিবাদে আকর্ষণ, হিন্দু রীতিতে নাবালিকা কন্যা সুনীতি দেবীর বিবাহ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের অভ্যন্তরে প্রবল দ্বন্দ্ব তৈরি করে । শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখরা ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই মে 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' থেকে বেরিয়ে গিয়ে 'সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ' প্রতিষ্ঠা করেন । বিভাজনের পর কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মসমাজের নাম হয় 'নববিধান ব্রাহ্মসমাজ' ।

'সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ' এর নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা প্রভৃতি কাজে আত্মনিয়োগ করেন । বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবা বিবাহের পক্ষে প্রচার চালান ।

*****

Comments

Related Items

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

প্রশ্ন : 'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন : হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

প্রশ্ন : উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?

প্রশ্ন : 'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?