আলিগড় আন্দোলন (Aligarh Movement)

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 23:11

আলিগড় আন্দোলন (Aligarh Movement) :

আলিগড় আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ (Sir Syed Ahmed Khan) । পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে যুক্তিবাদী আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে খ্যাত । ভারতীয় মুসলমান সমাজ এ যাবৎ সকল প্রকার সংস্কার আন্দোলন থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছিলেন । ইতিপূর্বে ওয়াহাবি ও ফরাজি  আন্দোলন হলেও তা রক্ষণশীল মুসলিম সমাজকে স্পর্শ করেনি । ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের পর অনগ্রসর মুসলিম সমাজে কিছু কিছু সংস্কারের প্রয়োজন অনুভূত হয় । হিন্দুদের তুলনায় অনগ্রসর পাশ্চাত্য শিক্ষায় উদাসীন মুসলিম সমাজের দুরবস্থার কথা স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ অবগত ছিলেন । স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ ইংরেজি ভাষার মাধমে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রগতির যথার্থ সোপান বলে মনে করতেন, তাই তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসারে উদ্যোগী হন ।

শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের প্রভাব (Impact of Aligarh Movement on spread of Muslim Education) :

(১) ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি গাজিপুরে একটি ইংরেজি স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন ।

(২) ইংরেজি ভাষায় লেখা মূল্যবান কিছু কিছু বই উর্দু ভাষায় অনুবাদ করে তা মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করার উদ্দেশ্যে তিনি বিজ্ঞান সমিতি (Scientific society) নামে একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন ।

(৩) তিনি মুসলমানদের মন থেকে পাশ্চাত্যের ভয় ভীতি দূর করার জন্য ও মুসলমানদের মধ্যে উদারনৈতিক ভাবধারা প্রচারের জন্য ‘তাহজিব-উল-আখলার্ক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন । সেই সঙ্গে কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং নামে একটি সংস্থারও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ।

(৪) অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে আলিগড়ে তিনি মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (Muhammedan Anglo-Oriental College) -এর প্রতিষ্ঠা করেন । এই কলেজটিই পরে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় (Aligarh Muslim University) নামে পরিচিত হয় । ইংরেজ শিক্ষাবিদগণের তত্ত্বাবধানে এই কলেজে কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় । মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও প্রগতিমূলক মনোভাবের উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে এই কলেজের অবদান অস্বীকার করা যায় না ।

(৫) আলিগড় আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাদের আধুনিক যুগোপযোগী ভাবধারায় দীক্ষিত করেছিল ।

(৬) এই আন্দোলন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যুক্তিবাদের প্রসার ঘটিয়ে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি পরিত্যাগেও সাহায্য করেছিল ।

(৭) এই আন্দোলন মুসলিম সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি, পর্দা প্রথার অপসারণ ও নারী শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে ।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলনের ফলাফল (Impact of Aligarh Movement on Political Platform) :

(১) আলিগড় আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে ।

(২) আলিগড় অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ ও ঘোর সাম্রাজ্যবাদী থিওডোর বেক -এর প্রভাবে আলিগড় আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমেদ খাঁ ইংরেজ শাসনের প্রতি আনুগত্য এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতার নীতি গ্রহণ করেন । ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা রুখতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তিনি ‘এডুকেশানাল কংগ্রেস’, ‘ইউনাইটেড পেট্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন’ ও 'মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে তিনি কংগ্রেসের তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা গঠন করেন ।

(৩) আলিগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার অপূর্ব সুযোগ পায় এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতিকে তোষণ করতে শুরু করে । বঙ্গভঙ্গ ছিল ইংরেজ সরকারের সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতির প্রথম দৃষ্টান্ত ।

(৪) সর্বোপরি আলিগড় আন্দোলনের কার্যকলাপ পরাধীন ভারতের রাজনীতিতে দ্বিজাতি তত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেয় ।

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলমানগণ আলিগড়ের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল । শুধুমাত্র উত্তর প্রদেশের উচ্চবিত্ত সমাজের মুসলমানরাই আলিগড় কলেজে শিক্ষার সুযোগ পায় । এইসব দোষত্রুটি সত্ত্বেও ভারতীয় মুসলমান সমাজের নবজাগরণে স্যার সৈয়দ আহমেদ তথা আলিগড় আন্দোলনের অবদান অস্বীকার করা যায় না । সাম্প্রদায়িক দিকটা ছাড়া মুসলমান সমাজের সংস্কার সাধনে স্যার সৈয়দ আহমেদের অবদান স্মরনীয় । এক্ষেত্রে তিনি রাজা রামমোহন রায়ের সমগোত্রীয় ছিলেন । রাজা রামমোহন রায়ের মতো স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁও মুসলিম সমাজে বহু বিবাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি তুলে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন । মুসলিমদের 'তালাক প্রথা, ও বোরখা তুলে দেওয়ারও তিনি পক্ষপাতী ছিলেন । তবে সাধারণভাবে রক্ষণশীল মুসলমান সমাজ তাঁর এসব সংস্কার প্রয়াস ভালোভাবে মেনে নেয় নি । ফলে তাঁর প্রয়াস অসম্পূর্ণ থেকে যায় । আলিগড় আন্দোলনের অবদান প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করে বলেছেন যে, ‘উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিন্দুদের কাছে যা ছিল, আলিগড় আন্দোলনও ছিল মুসলিমদের কাছে ঠিক তাই’ ।

*****

Related Items

সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন : সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন : শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।

নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী কী ? সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন : নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী কী ? সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ কর ।

নিরাপত্তা পরিষদের কাজ :

বান্দুং সন্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয় ? এই সন্মেলনের গুরুত্ব নির্ণয় কর । বান্দুং সম্মেলনের নেতৃত্বদানকারী দেশের নাম লেখ ।

প্রশ্ন : বান্দুং সন্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয় ? এই সন্মেলনের গুরুত্ব নির্ণয় কর । বান্দুং সম্মেলনের নেতৃত্বদানকারী দেশের নাম লেখ ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলি কী ?

প্রশ্ন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলি কী ?