এই অধ্যায়ে কারক, বিভক্তি, অনুসর্গ, কারকের শ্রেণিবিভাগ, -এর আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর ।
কারক ও অকারক সম্পর্ক
কারক —দশম শ্রেণির ব্যাকরণের পাঠ্যসূচীতে প্রথমেই রয়েছে কারকের স্থান । সংস্কৃতে বলা হয় 'ক্রিয়ান্বয়ী কারকম্' অর্থাৎ ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য নামপদগুলির (বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্বনাম পদ) অন্বয় বা সম্পর্ক তৈরি করে দেয় কারক । সুতরাং বলাই যায় যে — বাক্যের ক্রিয়াপদের সঙ্গে নামপদের সম্বন্ধই হল কারক ।
বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়াকে কিছু প্রশ্ন করে যে সম্পর্ক গুলি পাওয়া যায় সেগুলি কারক । যেমন— একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা যায় —"ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বত্রই মেয়েদের উন্নতির জন্য নিজ উদ্যোগে স্বল্প সঞ্চয় থেকেই অকাতরে অর্থ দান করতেন" ।
— কে দান করতেন ? → ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর → কর্তা সম্পর্ক → কর্তৃকারক
— কি দান করতেন ? → অর্থ → ক্রিয়ার সঙ্গে কর্ম সম্পর্ক → কর্মকারক
— কিসের দ্বারা দান করতেন ? → নিজ উদ্যোগে → ক্রিয়ার সঙ্গে করণ সম্পর্ক
— কিসের নিমিত্ত বা জন্য দান করতেন ? → মেয়েদের উন্নতির জন্য → নিমিত্ত সম্পর্ক
— কোথা থেকে গান করতেন ? → স্বল্প সঞ্চয় থেকে → অপাদান সম্পর্ক
— কোথায় দান করতেন ? → সর্বত্রই → অধিকরণ সম্পর্ক ।
এই উদাহরণ থেকে বলা যায় যে সম্পর্ক অনুযায়ী কারক ছয় প্রকার —
(১) কর্তৃকারক , (২) কর্মকারক, (৩) করণ কারক , (৪) নিমিত্ত কারক, (৫) অপাদান কারক , (৬) অধিকরণ কারক ।
বিভক্তি:- বিভক্তি হল ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ যা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শব্দকে পদে পরিণত করে এবং দুটি পদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে । বাক্যের ক্রিয়াপদের সঙ্গে অন্যান্য নামপদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে বিভক্তির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলেই কারকের আলোচনায় বিভক্তির আলোচনা এসে যায় ।
এ, কে, রে, তে , র ,এর — এগুলি বিভক্তির চিহ্ন । শূন্য বিভক্তি ও আছে তবে তা 'অ' হিসাবে চিহ্নিত । বাংলা ভাষায় যেহেতু কারক অনুযায়ী বিভক্তি নির্দিষ্ট নয়, তাই একই বিভক্তি বিভিন্ন কারকে যুক্ত হতে পারে ।
তির্যক বিভক্তি — যে বিভক্তি সব কারকেই ব্যবহৃত হয় তাকে তির্যক বিভক্তি বলে । 'এ' হল তির্যক বিভক্তি ।
অনুসর্গ — অনু = পশ্চাৎ, সর্গ = অবস্থান অর্থাৎ যে অব্যয়পদ বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের পরে স্বাধীনভাবে বসে বিভক্তির কাজ করে তাকে অনুসর্গ বলে । যেমন- পরিশ্রম ছাড়া সাফল্য অর্জন করা যায় না ।
নির্দেশক — বাংলা ভাষায় বিশেষ্য ও বিশেষণ পদের সঙ্গে যে বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যুক্ত হয়ে পদটিকে বিশেষিত করে তাকে নির্দেশক বলে । যেমন- টি , টা, খানি, থানা একটি বোঝাতে এবং গুলি, গুলো বহুবচন বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ।
কারকের শ্রেণি বিভাগ ও তার আলোচনা :-
(১) কর্তৃকারক — বাক্যে ক্রিয়ার কাজ যে করে বা করায় তাকে কর্তৃকারক বলে । যেমন - ছেলেটি ব্যাকরণ পড়ে । এখানে 'কে' দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর 'ছেলেটি' পাওয়া যায় । সুতরাং ছেলেটি কর্তৃকারক । কর্তৃকারকের কর্তা বিভিন্ন প্রকারের —
(ক) প্রযোজক কর্তা — মা শিশুটিকে দুধ খাওয়াচ্ছেন । এখানে কর্তা যখন অন্যকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নেয় তখন প্রযোজক কর্তা হয় ।
(খ) প্রযোজ্য কর্তা — প্রযোজক কর্তা যাকে দিয়ে কাজ করায় তাকে প্রযোজ্য কর্তা বলে । যেমন - মা শিশুকে চাঁদ দেখায় ।
(গ) ব্যতিহার কর্তা — বাক্যে যখন কোন ক্রিয়ার দুটি কর্তা পরস্পর একই কর্ম সম্পাদন করে — যেমন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় । ভাই ভাই লাঠালাঠি করছে ।
(ঘ) সমধাতুজ কর্তা — কোন বাক্যের ক্রিয়াপদ ও কর্তা একই ধাতু থেকে উৎপন্ন হয় তখন তাকে সমধাতুজ কর্তা বলে । যেমন — লেখক লেখে, রাঁধুনি রাঁধে ।
(ঙ) উহ্য কর্তা — যে বাক্যে কর্তা উহ্য থাকে কিন্তু ক্রিয়ার রূপ দেখে কর্তা অনুমান করা যায় তাকে উহ্য কর্তা বলে । এখানে এসো (তুমি) , কলমটা দে (তুই) ইত্যাদি । এরকম বিভিন্ন ধরনের কর্তা রয়েছে ।
(২) কর্মকারক — বাক্যের কর্তা যাকে আশ্রয় করে কোন ক্রিয়া সম্পাদন করে তাকেই কর্মকারক বলে । যেমন -মেয়েরা বই পড়ছে, ছেলেরা গান করছে । ক্রিয়াকে কি দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় বই, গান । সুতরাং এগুলি কর্ম অর্থাৎ কর্মকারক ।
বিভিন্ন প্রকারের কর্ম —
(ক) মুখ্য কর্ম ও গৌণ কর্ম — যে বাক্যে দুটি কর্ম থাকে তার একটি অপ্রাণীবাচক কর্ম যেটাকে মুখ্য বা প্রধান কর্ম বলে । আর একটি প্রাণীবাচক কর্ম যেটাকে বলা হয় গৌণ কর্ম । যেমন — মিরা সীমাকে একটি কলম দিয়েছে ।
কাকে দিয়েছে ? সীমাকে → প্রাণীবাচক কর্ম বা গৌণ কর্ম ।
কি দিয়েছে ? কলম → অ-প্রাণীবাচক বা মুখ্য কর্ম ।
(খ) সমধাতুজ কর্ম — যে বাক্যের কর্ম ও ক্রিয়া একই ধাতু থেকে উৎপন্ন হয় সেই কর্মকে সমধাতুজ কর্ম বলে । যেমন —সে কী কান্নাই না কাঁদলে ।
(গ) কর্মের বীপ্সা —বাক্যের একই কর্মপদের একাধিকবার উল্লেখ হলে, তাকে কর্মের বীপ্সা বলে । যেমন —জনে জনে শুধালেম । যা যা পছন্দ তুলে নাও । ইত্যাদি
(৩) করণ কারক —বাক্যের কর্তা যার সাহায্যে বা যা দিয়ে বা যে উপায়ে কোন কাজ করে, তাকে করণ কারক বলে । যেমন— 'মা বঁটিতে মাছ কাটে ।' আমরা কলম দিয়ে লিখি । বাক্যের ক্রিয়াপদকে কিসের দ্বারা / দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় -সেটাই করণ কারক ।
নানা প্রকারের করণ কারক —
(ক) যন্ত্রাত্মক করণ — কোনো যন্ত্র বা বস্তু দিয়ে বাক্যের ক্রিয়া সম্পাদন হয় যে করণে তাকে যন্ত্রাত্মক করণ বলে । যেমন —লাঠি দিয়ে সে সাপটিকে মারল । চাষীর লাঙল দিয়ে চাষ করে ।
(খ) উপায়াত্মক করণ — চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ হয় না । তারা আনন্দে আত্মহারা । উপায় -এর দ্বারা যখন কাজ সমাধা করা হয় তখন তাকে উপায়াত্মক করণ বলে ।
(গ) সমধাতুজ করণ —বাক্যের ক্রিয়াপদটি যে ধাতু থেকে উৎপন্ন হয় সেই একই ধাতু থেকে যদি করণ উৎপন্ন হয়, তবে সেই করণ কারককে সমধাতুজ করণ বলে । যেমন —এ সংসার মায়ার বাঁধনে বাঁধা ।
(ঘ) কালাত্মক করণ — কাল বা সময় যখন করণ কারকে প্রকাশ পায় তখন তাকে কালাত্মক করণ বলে । যেমন — বারোমাসে বছর হয় । এক মিনিটেই আমার কাজ হাসিল ।
(ঙ) হেতু বা কারনাত্মক করণ —যে করণে হেতু বা কারণ প্রকাশ পায়,তাকে হেতুময় বা কারনাত্মক করণ কারক বলে । যেমন —ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে । রাগে অন্ধ হয়ে মারপিট করছে ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য :- করণ কারকে বিভক্তি ও অনুসর্গ দুই প্রয়োগ হয় ।
বিভক্তির প্রয়োগ — স্রোতে নৌকা ভেসে যায় । এ - বিভক্তি
— টাকায় কিনা পাওয়া যায় । য় - বিভক্তি
— ছেলেরা ফুটবল খেলছে । শূন্য - বিভক্তি
অনুসর্গের প্রয়োগ — কলম দিয়ে লেখ । - দিয়ে
— সংগীত দ্বারা মানুষের মন জয় করা যায় । - দ্বারা ইত্যাদি
(৪) নিমিত্ত কারক — বাক্যের ক্রিয়া যখন কোন ব্যক্তি বা বস্তুর জন্য আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন সেই ব্যক্তি বা বস্তুকে নিমিত্ত কারক বলে । যেমন- ক্ষুদিরাম দেশের জন্য প্রাণ ত্যাগ করেছেন । মা মন্দির-দর্শনে বেরিয়েছেন । আনন্দের জন্য গান করি । বাক্যের ক্রিয়াপদকে কিসের জন্য বা কিসের নিমিত্ত দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তাকে নিমিত্ত কারক বলে । নিমিত্ত কারকে অনুসর্গ ব্যবহার করা হয় । জন্য, নিমিত্ত ইত্যাদি ।
(৫) অপাদান কারক — বাক্যের ক্রিয়াপদকে কোথা থেকে বা কিসের চেয়ে, অপেক্ষা, দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, তাকে অপাদান কারক বলে । যেমন - লোভ থেকে পাপ জন্মায় । 'বিপদে মোরে রক্ষা কর - এ নহে মোর প্রার্থনা' । সত্য ভ্রষ্ট হয়ো না । আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে । 'ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন' । ইত্যাদি
অপাদান কারকে বিভক্তি ও অনুসর্গ দুটির প্রয়োগ হয় ।
(৬) অধিকরণ কারক — বাক্যে ক্রিয়ার আধারকে অধিকরণ বলে । আধার তিন প্রকার– স্থান, কাল ও বিষয় । বাক্যের ক্রিয়া যখন এই তিনটি আধারে সংঘটিত হয় তখন তাকে অধিকরণ কারক বলে । যেমন— জলে থাকে মাছ । বনে থাকে বাঘ । মেয়েটি অংকে বেশ ভালো । সকালে ঘুম থেকে ওঠা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো ।
বাক্যের ক্রিয়াপদকে কোথায়, কখন বা কীসে ইত্যাদি দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তাকেই অধিকরণ কারক বলে । অধিকরণের প্রকারভেদ —
(ক) স্থানাধিকরণ — রবি কাকা দিল্লিতে থাকে । মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা বাজল ঢং ঢং
(খ) কালাধিকরণ — সকাল সাড়ে ছটায় আমাকে বেরোতে হয় । আগামীকাল রাখি পূর্ণিমা ।
(গ) বিষয়াধিকরণ — ধর্মে মতি রেখো । ছেলেটি অংকে ভালো নয় ।
(ঘ) অধিকরণে বীপ্সা — তারা বনে বনে মধু সংগ্রহ করে । গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে ।
অ-কারক সম্পর্ক—
বাক্যের যেসব নামপদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের সরাসরি কোন সম্পর্ক থাকে না, তাদের অ-কারক বলে । অ-কারক দু'রকম (ক) সম্বন্ধ পদ ও (খ) সম্বোধন পদ ।
(ক) সম্বন্ধ পদ — বাক্যের ক্রিয়াপদের সঙ্গে যে নামপদগুলির প্রত্যক্ষ যোগ বা সম্বন্ধ না থাকলেও অন্য নামপদের সম্বন্ধ থাকে, তাকে সম্বন্ধ পদ বলে । যেমন- জামায় কালির দাগ লেগেছে — র । মাছের তেলে মাছ ভাজা —এর প্রভৃতি । সম্বন্ধ পদে র, এর বিভক্তি থাকে ।
(খ) সম্বোধন পদ — কাউকে ডাকার সময় বা আহ্বান জানাতে যে পদ ব্যবহার করা হয়, তাকে সম্বোধন পদ বলে । বাক্যের ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্বোধন পদের সরাসরি কোনো যোগ সম্পর্ক নেই । সেজন্য সম্বোধন পদ কারক নয়, অ-কারক । ওহে, আমার এখানে এস । হে ভগবান, ওগো বিদেশিনী --- । বৎস, তোমার মায়ের নাম কি ? 'ওরে ভাই আগুন লেগেছে বনে ---' । এখানে ওহে, হে, বৎস, ওরে, ওগো, এগুলি সম্বোধন পদ ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য :-
বিভক্তি প্রধান কারক হল ৩টি —(ক) কর্তৃকারক , (খ) কর্মকারক (গ) অধিকরণ কারক
অনুসর্গ প্রধান কারক ৩টি — (ক) করণ কারক , (খ) নিমিত্ত কারক (গ) অপাদান কারক
******
- 29046 views