নদীর বিদ্রোহ

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 05/14/2020 - 16:55

নদীর বিদ্রোহ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

 

চারটা পঁয়তাল্লিশের প্যাসেঞ্জার ট্রেনটিকে রওনা করাইয়া দিয়া নদেরচাঁদ নূতন সহকারীকে ডাকিয়া বলিল, আমি চললাম হে !

নূতন সরকারী একবার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ ।

নদেরচাঁদ বলিল, আর বৃষ্টি হবে না, কী বলো ?

নূতন সরকারী একবার জলে জলময় পৃথিবীর দিকে চাহিয়া বলিল, আজ্ঞে না ।

নদেরচাঁদ লাইন ধরিয়া এক মাইল দূরে নদীর উপরকার ব্রিজের দিকে হাটিতে লাগিল । পাঁচদিন অবিরত বৃষ্টি হইয়া আজ এই বিকালের দিকে বর্ষণ থামিয়াছে । পাঁচদিন নদীকে দেখা হয় নাই । নদেরচাঁদ ছেলেমানুষের মতো ঔৎসুক্য বোধ করিতে লাগিল । আকাশে যেমন মেঘ করিয়া আছে, হয়তো আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল ধারায় বর্ষণ শুরু হইয়া যাইবে । তা হোক । ব্রিজের একপাশে আজ চুপচাপ বসিয়া কিছুক্ষণ নদীকে না দেখিলে সে বাঁচিবে না । পাঁচদিনের আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি না জানি নদীকে আজ কী অপরূপ রূপ দিয়াছে ? দুদিকে মাঠঘাট জলে ডুবিয়া গিয়াছিল, রেলের উঁচু বাঁধ ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে দুপাশে চাহিয়া চাহিয়া নদেরচাঁদ নদীর বর্ষণ-পুষ্ট মূর্তি কল্পনা করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল ।

ত্রিশ বছর বয়সে নদীর জন্য নদেরচাঁদের এত বেশি মায়া একটু অস্বাভাবিক । কেবল বয়সের জন্য নয়, ছোট হোক, তুচ্ছ হোক, সে তো একটা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার, দিবারাত্রি মেল, প্যাসেঞ্জার আর মালগাড়িগুলির তীব্রবেগে ছুটাছুটি নিয়ন্ত্রিত করিবার দায়িত্ব যাহাদের সেও তো তাহাদেরই একজন, নদীর জন্য এমনভাবে পাগলা হওয়া কি তার সাজে ? নদেরচাঁদ সব বোঝে, নিজেকে কেবল বুঝাইতে পারে না । নিজের এই পাগলামিতে যেন আনন্দই উপভোগ করে ।

অস্বাভাবিক হোক, নদীকে এভাবে ভালোবাসিবার একটা কৈফিয়ত নদেরচাঁদ দিতে পারে । নদীর ধারে তার জন্ম হইয়াছে, নদীর ধারে সে মানুষ হইয়াছে, চিরদিন নদীকে সে ভালোবাসিয়াছে । দেশের নদীটি তার হয়তো এই নদীর মতো এত বড়ো ছিল না, কিন্তু শৈশবে, কৈশোরে, আর প্রথম যৌবনে বড়োছোটোর হিসাব কে করে ? দেশের সেই ক্ষীনস্রোতা নির্জীব নদীটি অসুস্থ দুর্বল আত্মীয়ার মতোই তার মমতা পাইয়াছিল । বড়ো হইয়া একবার অনাবৃষ্টির বছরে নদীর ক্ষীণ স্রোতধারাও প্রায় শুকাইয়া যাইবার উপক্রম করিয়াছে দেখিয়া সে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল; দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগিতে ভুগিতে পরমাত্মীয়া মরিয়া যাওয়ার উপক্রম করিলে মানুষ যেমন কাঁদে ।

ব্রিজের কাছাকাছি আসিয়া প্রথমবার নদীর দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হইয়া গেল । পাঁচদিন আগেও বর্ষার জলে পরিপুষ্ট নদীর পঙ্কিল জলস্রোতে সে চাঞ্চল্য দেখিয়া গিয়াছে, কিন্তু সে চাঞ্চল্য যেন ছিল পরিপূর্ণতার আনন্দের প্রকাশ । আজ যেন সেই নদী খেপিয়া গিয়াছে, গাঢ়তর পঙ্কিল জল ফুলিয়া ফাঁপিয়া ফেনোচ্ছ্বাসিত হইয়া ছুটিয়া চলিয়াছে । এতক্ষন নদেরচাঁদ একটি সংকীর্ণ ক্ষীনস্রোতা নদীর কথা ভাবিতেছিল । তার চার বছরের চেনা এই নদীর মূর্তিকে তাই যেন আরও বেশি ভয়ংকর, আরও বেশি অপরিচিত মনে হইল ।

ব্রিজের মাঝামাঝি ইট, সুরকি আর সিমেন্টে গাঁথা ধারকস্তম্ভের শেষপ্রান্তে বসিয়া সে প্রতিদিন নদীকে দেখে । আজও সে সেইখানে গিয়া বসিল । নদীর স্রোত ব্রিজের এই দিকে ধারকস্তম্ভগুলিতে বাধা পাইয়া ফেনিল আবর্ত রচনা করিতেছে । এত উঁচুতে জল উঠিয়া আসিয়াছে যে, মনে হয় ইচ্ছা করিলে বুঝি হাত বাড়াইয়া স্পর্শ করা যায় । নদেরচাঁদের ভারী আমোদ বোধ হইতে লাগিল । পকেট খুঁজিয়া পুরাতন একটা চিঠি বাহির করিয়া সে স্রোতের মধ্যে ছুড়িয়া দিল । চোখের পলকে কোথায় যে অদৃশ্য হইয়া গেল চিঠিখানা ! উন্মত্ততার জন্যই জলপ্রবাহকে আজ তাহার জীবন্ত মনে হইতেছিল, তার সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়া চিঠিখানা যেন তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেলিয়াছে ।

দুদিন ধরিয়া বাহিরের অবিশ্রান্ত বর্ষণের সঙ্গে সুর মিলাইয়া নদেরচাঁদ বউকে প্রাণপণে একখানা পাঁচপৃষ্ঠাব্যাপী বিরহ-বেদনাপূর্ণ চিঠি লিখিয়াছে, চিঠি পকেটেই ছিল । একটু মমতা বোধ করিল বটে, কিন্তু নদীর সঙ্গে খেলা করার লোভটা সে সামলাইতে পারিল না, এক একখানি পাতা ছিঁড়িয়া দুমড়াইয়া মোচড়াইয়া জলে ফেলিয়া দিতে লাগিল ।

তারপর নামিল বৃষ্টি, সে কী মুষলধারায় বর্ষণ ! ঘন্টা তিনেক বিশ্রাম করিয়া মেঘের যেন নূতন শক্তি সঞ্চিত হইয়াছে ।

নদেরচাঁদ বসিয়া বসিয়া ভিজিতে লাগিল, উঠিল না । নদী হইতে একটা অশ্রুতপূর্ব শব্দ উঠিতেছিল, তাঁর সঙ্গে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মিশিয়া হঠাৎ এমন একটা সংগত সৃষ্টি করিয়াছে যে নদেরচাঁদের মন হইতে ছেলেমানুষি আমোদ মিলাইয়া গেল, তার মনে হইতে লাগিল এই ভীষণ মধুর শব্দ শুনিতে শুনিতে সর্বাঙ্গ অবশ, অবসন্ন হইয়া আসিতেছে ।

ক্রমে ক্রমে দিনের স্তিমিত আলো মিলাইয়া চারদিক অন্ধকারে ছাইয়া গেল, বৃষ্টি একবার কিছুক্ষণের জন্য একটু কমিয়া আবার প্রবলবেগে বর্ষণ আরম্ভ হইল, ব্রিজের উপর দিয়া একটা ট্রেন চলিয়া যাওয়ার শব্দে আকস্মিক আঘাতে ঘুম ভাঙ্গিয়া যাওয়ার মতো একটা বেদনাদায়ক চেতনা কিছুক্ষণের জন্য নদেরচাঁদকে দিশেহারা করিয়া রাখিল, তারপর সে অতিকষ্টে উঠিয়া দাঁড়াইল ।

বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদেরচাঁদের । হঠাৎ তাহার মনে হইয়াছে, রোষে ক্ষোভে উন্মত্ত এই নদীর আর্তনাদি জলরাশির কয়েক হাত উঁচুতে এমন নিশ্চিন্তমনে এতক্ষণ বসিয়া থাকা তাহার উচিত হয় নাই । হোক ইট, সুরকি, সিমেন্ট, পাথর, লোহালক্কড়ে গড়া ব্রিজ, যে নদী এমনভাবে খেপিয়া যাইতে পারে তাহাকে বিশ্বাস নাই ।

অন্ধকারে অতি সাবধানে লাইন ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে নদেরচাঁদ স্টেশনের দিকে ফিরিয়া চলিল । নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে । ব্রিজটা ভাঙ্গিয়া ভাসাইয়া লইয়া, দুপাশে মানুষের হাতে গড়া বাঁধ চুরমার করিয়া, সে স্বাভাবিক গতিতে বহিয়া যাইবার পথ করিয়া লইতে চায় । কিন্তু পারিবে কি ?

পারিলেও মানুষ কি তাকে রেহাই দিবে ? আজ যে ব্রিজ আর বাঁধ সে ভাঙ্গিয়া ফেলিবে, কাল মানুষ আবার সেই ব্রিজ আর বাঁধ গড়িয়া তুলিবে । তারপর এই গভীর প্রশস্ত, জলপূর্ণ নদীর, তার দেশের সেই ক্ষীণস্রোতা নদীতে পরিণত হইতে না জানি মোটে আর কতদিন লাগিবে ?

স্টেশনের কাছে নূতন রং করা ব্রিজটির জন্য এতকাল নদেরচাঁদ গর্ব অনুভব করিয়াছে । আজ তার মনে হইল কী প্রয়োজন ছিল ব্রিজের ?

বোধহয়, এই প্রশ্নের জবাব দিবার জন্যই পিছন হইতে ৭নং ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি নদেরচাঁদকে পিষিয়া দিয়া চলিয়া গেল ছোটো স্টেশনটির দিকে, নদেরচাঁদ চার বছর যেখানে স্টেশন মাস্টারি করিয়াছে এবং বন্দি নদীকে ভালোবাসিয়াছে ।

***

Comments

Related Items

কোনির পারিবারিক জীবনের পরিচয় দাও

কোনির পারিবারিক জীবনের পরিচয় দাও

প্রবন্ধ রচনা (Essay Writing)

প্রবন্ধ রচনা  —

রক্তদান জীবন দান এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন কর

রক্তদান জীবন দান এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন কর

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা, ১০ই আগস্ট, ২০২১

প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা কর

প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা কর

উত্তর :-

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা ১০ই আগস্ট, ২০২১

আম্ফানের তান্ডবে লণ্ডভণ্ড দক্ষিণবঙ্গ

আম্ফানের তান্ডবে লণ্ডভণ্ড দক্ষিণবঙ্গ

নিজস্ব সংবাদদাতা, বেলতলা রোড, কলকাতা, ২১শে মে, ২০০০