মগধের উত্থান (Rise of Magadha)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/17/2012 - 18:04

মগধের উত্থান (Rise of Magadha) :

পরপর চারটি শক্তিশালী রাজবংশের ধারবাহিক রাজত্ব মগধের উত্থান সম্ভব করেছিল । সেই চারটি রাজবংশ হল— (১) হর্ষঙ্ক বংশ, (২) শিশুনাগ বংশ, (৩) নন্দ বংশ ও (৪) মৌর্য বংশ ।

(১) হর্ষঙ্ক বংশ (Haryanka Dynasty) : মগধ সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হর্ষঙ্ক বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা বিম্বিসার । তিনি প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য জয় করেন । তিনি কৌশল রাজ্যকন্যা কোশলদেবীকে বিবাহ করে যৌতুক হিসাবে কাশী লাভ করেন । বৈশালীর লিচ্ছবি রাজকন্যা চেল্লনাকে বিবাহের সূত্রে তিনি উত্তর বিহারে মগধের প্রাধান্য বিস্তারের পথ প্রশস্থ করেন । তিনি শাসক হিসাবেও দক্ষতার পরিচয় দেন । গিরিব্রজে রাজধানী স্থাপন করে তার নাম দেন রাজগৃহ বর্তমানে রাজগির । তিনি পুত্র অজাতশত্রুর হাতে নিহত হন । স্বামী শোকে ভগ্নী কোশলদেবী প্রাণত্যাগ করায় কোশলরাজ প্রসেনজিৎ অজাতশত্রুর ওপর ক্রুদ্ধ হন । কিন্তু তিনি অজাতশত্রুর হাতে পরাজিত হন এবং নিজ কন্যা ভাজিরাকে অজাতশত্রুর সঙ্গে বিবাহ দেন । ব্রিজিও অজাতশত্রুর অধীনে আসে । তিনি তাঁর রাজধানী পাটলিপুত্রে স্থানান্তরিত করেন ।

(২) শৈশুনাগ বংশ (Sisunaga Dynasty) : মগধের অভ্যুত্থানের পর শৈশুনাগ বংশের প্রতিষ্ঠাতা শিশুনাগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনি বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মগধের রাজ্য বিস্তার নীতি অক্ষুণ্ণ রাখেন । তাঁর হাতে অবন্তীরাজ প্রদ্যোৎ পরাজিত হন এবং অবন্তী মগধের অন্তর্ভুক্ত হয় ।

(৩) নন্দ বংশ- মহাপদ্মনন্দ (Nanda Dynasty) : নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্ম নন্দের হাতে মগধ বংশের সর্বাধিক বিস্তার ঘটে । পুরাণের মতে তিনি সমস্ত ক্ষত্রিয়দের (পাঞ্চাল, কলিঙ্গ, কাশী, অশ্মক, কুরু, সুরেন, মথিলা ইত্যাদি) পরাজিত করে এক সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি দক্ষিণ ভারতের কুন্তল (মহীশূর) অধিকার করেন । কোনো কোনো ঐতিহাসিকের (যেমন­­­­­­­- রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়) মতে তিনিই ছিলেন উত্তর ভারতের প্রথম সম্রাট । শোনা যায় তার পরাক্রমের ভয়ে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সৈন্যদল ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চায় নি । মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাতে মগধের উত্থান পরিপূর্ণ রূপ পায় ।

মগধের উত্থানের কারণ (Causes of the rise of Magadha) :

অন্য মহাজনগুলিকে পিছনে ফেলে মগধের অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল কয়েকটি কারণে ।

(১) পর পর চারটি শক্তিশালী রাজবংশের অভ্যুত্থান এবং বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ, মহাপদ্ম নন্দ ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মতো বীর যোদ্ধা অন্য কোনো মহাজনপদে আবির্ভুত হয় নি ।

(২) প্রাকৃতিক সম্পদে অন্য কোনো মহাজনপদ মগধের মতো সমৃদ্ধিশালী ছিল না । এখানে যেমন প্রচুর শস্য উৎপন্ন হত,  তেমনই খনিজ সম্পদে, বিশেষত লোহা উৎপাদনে মগধের সমকক্ষ কেউ ছিল না । লোহা দিয়ে লাঙল, কাস্তে ইত্যাদি যেমন তৈরি হত, তেমনই অস্ত্রশস্ত্রও তৈরি হত ।

(৩) মগধের ভৌগোলিক অবস্থান তার অভ্যুত্থানের সহায়ক হয়েছিল । তার দুই রাজধানী রাজগৃহ ও পাটলিপুত্র প্রকৃতির দ্বারা সুরক্ষিত ছিল বলে বহিরাগত শত্রুর পক্ষে তা দখল করা কার্যত অসম্ভব ছিল ।

(৪) মগধে আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল ।

(৪) মৌর্যবংশ (Maurya Dynasty) :

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (Chandragupta Maurya) : মন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দ বংশের শেষ রাজা ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করে মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলেই ৩২৪ খ্রি. পূ. থেকে ৩২০ খ্রি. পূ. মগধ সম্রাজ্যের চরম বিস্তার ঘটেছিল । চন্দ্রগুপ্তের বংশ পরিচয় ও বাল্য জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্যই সঠিকভাবে জানা যায় না । এক একটি সূত্রে এক এক রকম তথ্য পরিবেশিত হয়েছে ।

(১) একটি সূত্র অনুসারে চন্দ্রগুপ্তের মা অথবা দিদিমা শূদ্রকন্যা মুরার নাম অনুসারে তাঁর বংশের নামকরণ হয়েছিল মৌর্যবংশ । অর্থাৎ তিনি শূদ্র বংশজাত । গ্রিক লেখক জাস্টিনও মনে করেন, চন্দ্রগুপ্ত কোনো নীচু বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ।

(২) বৌদ্ধ সূত্রে বলা হয়েছে, তিনি ক্ষত্রিয় সন্তান । মধ্যযুগের লিপিতেও তাই উল্লেখ আছে ।

(৩) জৈন সূত্রে তাকে বলা হয়েছে ময়ূরপোষক, তিনি বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গলে ময়ূর পালকদের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন । তাই তাঁর বংশের নামকরণ হয়েছিল মৌর্যবংশ ।

রাজ্যবিস্তার (Extension of the Empire) : নন্দবংশের উচ্ছেদে তিনি যে কৌটিল্য বা চাণক্যের সহায়তা পেয়েছিলেন, তা ঐতিহাসিক সত্য । চন্দ্রগুপ্তের আর একটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে গ্রিকদের বিতাড়ন । ৩৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে গ্রিক সেনাপতি সেলুকাসকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বেলুচিস্তান দখল করেন । সেলুকাস তাঁর কন্যা হেলেন -এর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দেন । এইভাবে তিনি তাঁর সাম্রাজ্য মগধ থেকে সিন্ধুতীর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন । তার পর তিনি মালয় ও কাথিয়াবাড় তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । তাঁর সাম্রাজ্য সীমা সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । তামিল সূত্রে জানা যায় একজন মৌর্য রাজা তিনেভেল্লি জেলা পর্যন্ত অঞ্চল দখল করেন । তবে এই মৌর্যরাজ চন্দ্রগুপ্ত না কোঙ্কনের কোনো মৌর্যরাজ, তা নিয়ে বিতর্ক আছে । চন্দ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত অগ্রসর হলেও তা তিনি সরাসরি নিজ অধিকারে রাখতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না । বাংলাও খুব সম্ভবত তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । এর আগে কোনো রাজার সাম্রাজ্যের আয়তন এত বড় ছিল না । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই ছিলেন প্রথম নরপতি, যিনি প্রায় সর্বভারতীয় একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন । ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর ভাষায় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন “first historical founder of a great empire in India.”

মৌর্য শাসনব্যবস্থা (Maurya Administration) : চন্দ্রগুপ্ত যেমন সামরিক শক্তির পরিচয় দেন , তেমনি তিনি একজন দক্ষ প্রশাসকও ছিলেন । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও সেলুকাস প্রেরিত গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা থেকে তাঁর শাসনব্যাবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় ।

(১) চন্দ্রগুপ্তের শাসনব্যাবস্থা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক । রাজাই ছিল সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী । আইন, বিচার, শাসন ও সামরিক ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন সম্রাট । তবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি শাসনকার্যে মন্ত্রিপরিষদের সাহায্য গ্রহণ করতেন । রাজা প্রয়োজনে মন্ত্রিপরিষদের সুপারিশ অগ্রাহ্য করতে পারতেন ।

(২) রাজকার্যে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন কর্মচারী নিযুক্ত করা হত । এঁদের মধ্যে অমাত্যরা ছিলেন রাজস্ব, অর্থ, বিচার, প্রশাসন প্রভৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিষ্ঠিত । অর্থশাস্ত্র থেকে আমরা ১৮টি সর্বোচ্চ পদের (তীর্থ) নাম জানতে পারি, যার মধ্যে মন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী), পুরোহিত, যুবরাজ ও সেনাপতি ছিলেন প্রধান । বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব থাকত অধ্যক্ষদের হাতে । অর্থশাস্ত্রে ৩২ জন অধ্যক্ষের নাম পাওয়া যায় । কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে জাতিগত বা সম্প্রদায়গত কোনো বাধা ছিল না । কর্মচারীদের নগদ বেতন দেওয়া হত । মৌর্য সম্রাট গুপ্তচর মারফত দেশের সব খবরাখবর রাখতেন ।

(৩) রাজা বিচার বিভাগের প্রধান হলেও গ্রাম ও শহরে বিশেষ বিচারালয় ছিল ।

(৪) মৌর্য যুগে উৎপন্ন শস্যের ১/৬ অংশ রাজস্ব হিসাবে গ্রহণ করা হত, যদিও প্রয়োজনে এই হার কমানো বা বাড়ানো হত । এই যুগে দু-ধরনের করের কথা জানা যায় । যথা— ভাগ ও বলি । ভাগ ছিল ভূমিকর । আর বলি ছিল এক বিশেষ ধরনের কর, যা জমি থেকে আদায় করা হত কয়েকজন কর্মচারীর বেতন প্রদানের জন্য ।

(৫) কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটা বড়ো অংশ ব্যয়িত হত সামরিক খাতে । সামরিক বিভাগের দায়িত্ব ছিল ৩০ জন সদস্যবিশিষ্ট এক পরিষদের উপর, যা আবার ৫ জন সদস্য নিয়ে ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল । এই বিভাগগুলি অশ্ব, রথ, হস্তী, পদাতিক, নৌ-বহর এবং খাদ্য ও পরিবহণের দায়িত্ব বহন করত ।

(৬) শাসন কার্যের সুবিধার জন্য মৌর্য সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশ এবং প্রদেশগুলি আবার অহর ও বিষয়ে (জেলা) বিভক্ত ছিল । প্রদেশের শাসনভার প্রধানত রাজ পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হত । সবশেষে ছিল গ্রাম যার পরিচালনা করতেন গ্রামিক । চার পাঁচটি গ্রামের দায়িত্বে থাকতেন “গোপ” । পাটলিপুত্রের শাসনদায়িত্ব ছিল ৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদের হাতে, যা আবার ৫ জন সদস্য নিয়ে ৬টি ভাগে বিভক্ত ছিল । এক একটী বিভাগ এক একটি বিষয়ের দায়িত্বে থাকত । মৌর্য শাসনব্যাবস্থা দক্ষতার সঙ্গে প্রজাকল্যাণের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল ।

অশোক (Ashoka) (আনুমানিক ২৭৩ - ২৩২ খ্রি.পূ.) : চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার (৩০০-২৭৩ খ্রি.পূ.) অমিত্রঘাত উপাধি নিয়ে মগধের সিংহাসনে বসেন ।  তিব্বতীয় ঐতিহাসিক তারানাথের মতে বিন্দুসার সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার  করেন । বিন্দুসারের মৃত্যুর পর অশোক মগধের সিংহাসনে বসেন ।

(১) কলিঙ্গযুদ্ধ জয় (The Conquest of Kalinga War) : অশোক জীবনে একটিমাত্র যুদ্ধ করেছিলেন । সেই যুদ্ধ হল কলিঙ্গের বিরুদ্ধে । দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে স্থল ও জলপথে যোগাযোগের জন্য কলিঙ্গ জয় জরুরি ছিল । অশোক অনায়াসেই কলিঙ্গ জয় করেন । কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ ও রক্তক্ষয় দেখে তাঁর মনে অনুশোচনা হয় । যুদ্ধ ত্যাগ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ও ধর্মপ্রচারে মন দেন । অবশ্য বর্তমানে আব্রাহাম এরিলিসহ অনেক আধুনিক গবেষক মনে করেন অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের আগেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । এরপর তিনি আর যুদ্ধ করেন নি । তা করবার আর দরকারও হয়নি, কারণ নতুন করে রাজ্যজয়ের আর প্রয়োজন ছিল না । ড. রোমিলা থাপার মনে করেন এটিই অশোকের পরবর্তীকালে যুদ্ধ না করার মূল কারণ । যুদ্ধ ত্যাগ করলেও কলিঙ্গ কিন্তু তিনি কলিঙ্গবাসীকে ফিরিয়ে দেন নি । যাই হোক, এই যুদ্ধের ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের চুড়ান্ত বিস্তৃতি ঘটেছিল । উত্তরে কাবুল উপত্যকা ও যোন, কম্বোজ ও গান্ধার থেকে দক্ষিণে গোদাবরী-কৃষ্ণা অববাহিকায় অন্তরাজ্য ও উত্তর মহীশূর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল । পশ্চিমে সোপারা ও গিরনাথ থেকে পূর্বে ধৌলি ও জোগাড় পর্যন্ত অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । বাংলা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল কিনা, বলা কঠিন; কারণ এখানে তাঁর কোনো শিলালিপি আবিষ্কৃত হয় নি । তবে হিউয়েন সাঙ তাম্রলিপ্ত (তমলুক), সমতট (পূর্ব বাংলা), পুন্ড্রুবর্ধন (উত্তর বাংলা) প্রমুখ স্থানে অশোকের স্তুপ দেখেছিলেন । তাই অনেকে মনে করেন বাঙলা অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । তবে কামরূপ তাঁর সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল ।

(২) অশোকের ধর্ম (Asoka's Dhamma) : বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হবার আগে অশোক ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন । কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহনের মতে তিনি ছিলেন শিবের উপাসক । সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন ও একজন সাধারণ উপাসক ছিলেন; তিনি সর্বত্যাগী সন্নাসী হন নি । সর্বদাই তিনি রাজধর্ম ও রাজার কর্তব্য পালন করে গেছেন । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বৌদ্ধধর্মের উপাসক হলেও জনগণের মধ্যে তিনি যে ধর্মমত প্রচার করেন, তা প্রকৃতই বৌদ্ধধর্ম ছিল কিনা, তা নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক ভিন্ন মত পোষণ করেন । তিনি তাঁর প্রচারিত ধর্মকে বৌদ্ধধর্ম না বলে শুধু ধম্ম বা ধর্ম বলে অভিহিত করেছেন । জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্য যে সব আদর্শ তিনি স্তম্ভলিপি ও শিলালিপির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের নৈতিক ও মানষিক উৎকর্ষ বিধান । কোনো বিশেষ ধর্মের আদর্শ এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়নি । মানবতার আদর্শ ও সর্বধর্মের সারবস্তু তিনি জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরেন । তিনি মনে করতেন সাধারণ গৃহীর পথ আর সংসারত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষুর পথ এক নয় । তাই সহজবোধ্য ভাষায় তিনি কয়েকটি নৈতিক অনুশাসন জনগণের মধ্যে প্রচার করেন । এই নৈতিক অনুশাসন হল দয়া, দান, সত্যানুরাগ, শুচিতা, নম্রতা, সংযম, ভাবশুদ্ধি, সাধুতা, অল্প ব্যয়, অল্প সঞ্চয়, অহিংসা, সৎ আচরণ ইত্যাদি । তিনি নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদির থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছেন । জোর দিয়েছেন পিতা-মাতা ও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, দাস ও ভৃত্যদের প্রতি সৎ ব্যাবহার, অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ইত্যাদির উপর । তিনি নিজে ব্রাহ্মণ ও আজীবকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । পরধর্মসহিষ্ণুতা তাঁকে মহান করেছেন । রামশরণ শর্মা, ব্রতীন মুখোপাধ্যায়, আব্রাহাম এরিলসহ অনেকেই অশোকের পরধর্মশহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছেন । তিনি যা প্রচার করতেন, তা মেনেও চলতেন ।

(৩) অশোকের ধর্মপ্রচার (Asoka's Missionary Activities) : অশোক তাঁর নৈতিক অনুশাসনকে কেবলমাত্র শিলালিপির মধ্যে আবদ্ধ রাখেন নি। এই সব আদর্শ জনগণ যাতে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে তার জন্য তিনি যুত, রাজুক, ধর্মমহামাত্র প্রভৃতি কর্মচারীদের নিযুক্ত করেন । নারীদের নৈতিক উন্নতির জন্য বিশেষ কর্মচারী নিযুক্ত করা হয় । তা ছাড়া উৎসব অনুষ্ঠান, দিব্যরূপ প্রদর্শন (বিমান দর্শন) প্রভৃতি বিভিন্ন বিনোদনের  মাধ্যমেও তিনি ধর্ম প্রচার করেন । তিনি নিজে বিহার যাত্রার পরিবর্তে ধর্মযাত্রা শুরু করেন । ধর্ম যাত্রার অর্থ গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলিতে গিয়ে বুদ্ধের বাণী প্রচার করা । ভেরী ঘোষের পরিবর্তে ধর্মঘোষ ধ্বনিত হয় । ভারতের বাইরেও যাতে ধর্মের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে, তার জন্য তিনি রাজ্যবিজয় নীতির পরিবর্তে ধর্মবিজয় নীতি গ্রহণ করেন । তিনি বিভিন্ন দিকে বৌদ্ধ প্রচারক প্রেরণ করেন । সিরিয়া, মিশর, ম্যাসিডন এপিরাসে দূত পাঠিয়েছিলেন বলে অশোক দবি করেন । সিংহলে (শ্রীলঙ্কা) নিজ পুত্র বা ভ্রাতা মহেন্দ্রকে তিনি পাঠিয়ে ছিলেন । বিদেশে তার এই ধর্ম প্রচার কতদূর সফল হয়েছিল তা বলা কঠিন ।

(৪) অশোকের জনহিতকর কাজ (Asoka's Welfare Activities) : অশোক তাঁর শিলালিপিতে বলেছেন “সকল মানুষই আমার সন্তান”। সন্তান তুল্য প্রজাদের সুখী করা, তাদের হিতসাধনকরা তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ছিল । তিনি সারা জীবন রাজ্যব্যাপী জলকষ্ট দূর করতে কূপ খনন করিয়েছিলেন, জনসাধারণের সুবিধার জন্য রাস্তার দুধারে বৃক্ষরোপণ করিয়েছিলেন, আম্রকুঞ্জ স্থাপন করিয়েছিলেন, পশু চিকিৎসার ব্যাবস্থা করিয়েছিলেন । অপরাধীদের জন্য শাস্তির পরিমাণ লাঘব করেছিলেন । অশোক মৃত্যু দন্ড রহিত করেন নি । তিনি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যাক্তিকে তিনদিনের অবকাশ লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন । পশু হত্যা নিষিদ্ধ করেন ।

(৫) ইতিহাসে অশোকের স্থান (Asoka's place in History) : পৃথিবীর ইতিহাসে অশোক এক ব্যাতিক্রমী সম্রাট । আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার ও নেপোলিয়নের মতো তিনি দিগ্বীজয়ী বীর ছিলেন না । রাজ্যবিজয় নয় ধর্মবিজয় ছিল তাঁর নীতি । প্রজাদের হৃদয় জয় করা ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য । প্রজাকল্যাণ ছিল তাঁর রাজধর্ম । প্রজাদের তিনি সন্তানের মতো দেখতেন । জনহিতকর কাজ করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেন নি । ধর্মের মাধ্যমে তিনি প্রজাদের নৈতিক ও মানসিক উন্নতির জন্য আন্তরিক ও ঐকান্তিক চেষ্টা করেছিলেন । তিনি কেবল ভারতবাসীর আত্মার উন্নতির কথা চিন্তা করেননি । সমগ্র মানবজাতির নৈতিক ও পারমার্থিক উন্নতির এমন দরদি প্রয়াস পৃতিবীর ইতিহাসে আর কোনো রাজার মধ্যে দেখা যায় নি । ক্ষমা ও দয়া তাঁর কাছে দুর্বলতা ছিল না । রাজধর্ম পালনে তিনি কঠোরতা ও কোমলতার সেতুবন্ধন ঘটিয়ে ছিলেন । “তিনি দন্ডের সহিত ক্ষমা, শক্তির সহিত সংযমের এবং আদর্শের সহিত বাস্তবের ঐক্য স্থাপন করিয়াছিলেন”। প্রজাকল্যাণ যদি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হয়, মানবতাই যদি মানুষ্যত্ব বিচারের মানদন্ড হয়, তাহলে অশোক নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্রাট । এইচ. জি. ওয়েলেস বলেছেন- “ইতিহাসে শত সহস্র সম্রাটের মধ্যে কেবল অশোকের নামই একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত আলো বিকিরণ করছে । কনস্ট্যানটাইন বা শার্লামেন অপেক্ষা তাঁর নাম আজও মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে” । ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরির মতে “অশোকের মধ্যে ছিল চন্দ্রগুপ্তের উদ্যম, সমুদ্রগুপ্তের বহুমুখী প্রতিভা ও আকবরের উদারতা” ।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন (Decline of the Mauryas) : অশোকের মৃত্যর পর ৫০ বছরের মধ্যে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হয় ও ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয় । মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অশোকের ধর্মনীতি ও ব্রাহ্মণ বিদ্বেষকে দায়ী করেছেন । আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন তাঁর অহিংসা নীতি মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ । উভয় বক্তব্যই বিশ্বাসযোগ্য নয় । কারণ অশোক পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন এবং এমন কিছু করেননি, যাতে ব্রাহ্মণদের ক্ষতি হয় । বরং তিনি ব্রাহ্মণদের সন্মানের চোখেই দেখতেন । অন্যদিকে অশোক অহিংসা নীতি অনুসরণ করলেও সৈন্যদল ভেঙে দেয়নি । তিনি যুদ্ধ নীতি পরিত্যাগ করেছিলেন, কারণ নতুন করে আর যুদ্ধের প্রয়োজন হয়নি । মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য গভীরতর রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কারণ ছিল । যে-কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অস্তিত্ব নির্ভর করে সম্রাটের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও দক্ষতার উপর । অশোকের পরবর্তী মৌর্য শাসকদের মধ্যে এই দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব ছিল বলে মৌর্য সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও ত্রুটিগুলি তাঁদের সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে ।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন থেকে (আনুমানিক ১৮৫ খ্রি.পূ.) গুপ্তযুগের অভ্যুত্থান (৩২০ খ্রি.) পর্যন্ত সময়ে ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না । এই সময়ে ইতিহাসে তিনটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়—

(১) উত্তর পশ্চিম ভারতে একের পর এক বৈদেশিক আক্রমণ (গ্রিক, শক, পহ্লব, কুষাণ ইত্যাদি) রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত করে । এই সব বিদেশি আক্রমণকারীদের মধ্যে একমাত্র কণিষ্কের নেতৃত্বে কুষাণরা ভারতে একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয় ।

(২) আপাতত মগধের গৌরবের দিন অস্তমিত হয় এবং এখানে প্রথমে শুঙ্গ ও পরে কান্ব বংশ একটি সংকীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে মগধের অস্তিত্ব বজায় রাখে ।

(৩) মগধের পতনের সুযোগে কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব ঘটে । এর মধ্যে কলিঙ্গ (রাজা খারবেল) ও সাতবাহনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।

*****

Related Items

রাজনৈতিক আধিপত্য লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতা

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়েছিল এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব ঘটেছিল । রাজনৈতিক প্রাধান্যের জন্য এদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগেই ছিল । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো শক্তিই সার্বভৌম ...

আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - দক্ষিণ ভারত

বাতাপির চালুক্য বংশ - উত্তর মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভে বাকাটকদের পতনের পর চালুক্য বংশের উদ্ভব হয় । রাষ্ট্রকূট বংশ - চালুক্যদের পতনের পর রাষ্ট্রকূটদের উদ্ভব হয় । কল্যাণীর চালুক্য বংশ - রাষ্ট্রকূট বংশের শেষ রাজা দ্বিতীয় কর্ককে, কাঞ্চীর পল্লব বংশ- সাতবাহন বংশের পতনের পর কৃষ্ণা থেকে ...

বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - বাংলা

শশাঙ্ক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলে বাংলা প্রথম সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে । পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের সুযোগ্য পুত্র ধর্মপাল ...

আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ - পশ্চিম ও উত্তর ভারত

বলভীর মৈত্রিক বংশ, যশোধর্মণ, কনৌজের উত্থান - মৌখরী বংশ, পুষ্যভূতি বংশ ও হর্ষবর্ধন, প্রতিহার বংশ, হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রতিহার বংশ উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রভাব শালী হয়ে পড়ে। প্রতিহার বা গুর্জর প্রতিহাররা ছিল রাজপুত জাতির একটি শাখা । এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ...

গুপ্ত সাম্রাজ্য (Gupta Dynasty)

কুষাণ ও সাতবাহন উভয় সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হলেও অয়তনের দিক থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজের তুলনায় ছোটো ছিল । গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রধানত বিহার ও উত্তর প্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল । বিহার অপেক্ষা উত্তর প্রদেশই ছিল এই সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং গোড়ার ...