ভক্তি আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ধর্মপ্রচারকগণ

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 09/25/2014 - 08:57

ভক্তি আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ধর্মপ্রচারকগণ :

রামানন্দ ও নামদেব (Ramananda and Namdev) : ভক্তি আন্দোলনের ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে রামানন্দ ও নামদেবের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য । রামানন্দ ছিলেন রামের উপাসক । সহজ হিন্দিতে তিনি জনগনের মধ্যে ভক্তিবাদ প্রচার করেন । তিনি জাতিভেদ প্রথা মানতেন না । তাঁর শিষ্যদের মধ্যে রবিদাস ছিলেন মুচি, কবির ছিলেন জোলা, সেনা ছিলেন নাপিত ও ধন্না ছিলেন জাঠ চাষী । নামদেবও রামানন্দের মতো জাতিভেদ প্রথার বিরোধী ছিলেন । তিনি মনে করতেন প্রেম ও ভক্তির দ্বারাই ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে । এখানে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই ।

কবির (Kabir) : কবির ছিলেন রামানন্দের প্রধান শিষ্য । সরল হিন্দিতে তিনি তাঁর বাণী ও আদর্শ প্রচার করতেন । তিনি প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের যে আদর্শ প্রচার করেন, তা সমস্ত শ্রেণির মানুষের মন স্পর্শ করে । তিনি মনে করতেন রাম, হরি আল্লাহ, গোবিন্দ, সাহিব প্রভৃতি যে নামেই ঈশ্বরকে ডাকা হোক না কেন, ঈশ্বর একমেবাদ্বিতীয়ম । মূর্তিপূজা, তীর্থযাত্রা, পবিত্র নদীতে স্নান, নামাজ পাঠ, ইত্যাদির মাধ্যমে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না । গৃহী জীবন পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস জীবনই অধ্যাত্মসাধনের উপায় বলে তিনি মনে করতেন । তাঁর আদর্শ ছিল বিশ্বপ্রেম, যা সর্বধর্ম ও জাতির ঊর্ধ্বে । হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । তাঁর রচিত দোঁহা আজও জনপ্রিয় ।

গুরুনানক (Guru Nanak) : শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গুরুনানক । তিনি ১৪৬৯ খ্রীষ্ঠাব্দে পাঞ্জাবের তাল বন্দি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন । কবিরের মতো তিনিও একেশ্বরবাদ, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও সাম্যের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন । জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ তিনি মানতেন না । চারিত্রিক শুদ্ধতা ও সৎ আচরণই তিনি ঈশ্বর প্রাপ্তির পথ বলে তিনি মনে করতেন । মূর্তিপূজা, তীর্থযাত্রা প্রভৃতি ধর্মের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের অসারতার ওপরও তিনি জোর দেন । সঠিক পথে চলার জন্য গুরুর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে বলে তিনি মনে করতেন । গৌতম বুদ্ধের মতো তিনিও মনে করতেন অত্যধিক ভোগবিলাস ও সন্ন্যাসীর জীবনের মাঝামাঝি পথই গ্রহণ করা উচিত । কোন নতুন ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না । তিনি হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য ঘুচিয়ে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের একটা পরিবেশ তৈরি করতে আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন । ‘নাম’, ‘দান’ ও ‘স্নান’ ছিল তাঁর প্রদর্শিত পথ । ‘গ্রন্থসাহেব’ গ্রন্থে তাঁর চিন্তাধারা ও উপদেশ সংকলিত হয়েছে । তাঁর শিষ্যরা ‘শিখ’ নামে পরিচিত হয় ।

শ্রীচৈতন্য (Srichaitanya) : ভক্তিবাদ ও বৈষ্ণব আদর্শের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন শ্রীচৈতন্য । তিনিও প্রথা সর্বস্ব ব্রাহ্মণ্য আচার অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করতেন না । তিনি মনে করতেন ভালোবাসা ও ভক্তির পথে এবং কৃষ্ণ নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া যায় । জাতিধর্ম নির্বিশেষে তাঁর মত প্রচারিত হয় । সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ ও কিছু মুসলমানও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । তিনিও জাতিভেদ প্রথা মানতেন না । তাঁর অগুণিত শিষ্যের মধ্যে রূপ-সনাতন, জীব গোস্বামী, নিত্যানন্দ, শ্রীবাস এবং যবন হরিদাসের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ।

বল্লভাচার্য : আর একজন বিখ্যাত বৈষ্ণব কৃষ্ণ ভক্তের নাম হল বল্লভাচার্য । তাঁর ধর্মচিন্তার মূল কথা হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ । ভাগবত গীতা ও ব্রহ্মসূত্রের টীকা এবং 'শুদ্ধ অদ্বৈত’ নামে একেশ্বরবাদ সম্পর্কে তিনি গ্রন্থও রচনা করেন । ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন । ভক্তিবাদের অন্যান্য প্রবক্তাদের মধ্যে নামদেব, মীরাবাঈ ও দাদুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

নামদেব (Namdev) : নামদেব সাধারণ দর্জি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি একেশ্বর বাদে বিশ্বাসী ছিলেন । ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বর নয়, প্রেম ও ভক্তিই ঈশ্বর সাধনার একমাত্র পথ বলে তিনি মনে করতেন । তিনিও জাতিভেদ প্রথা মানতেন না । হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের মানুষ তাঁর শিষ্য ছিল ।

মীরাবাঈ : রাজপুত সাধিকা কৃষ্ণপ্রেমে নিবেদিত প্রাণ মীরাবাঈ ভজন গানের মাধ্যমে প্রেম এবং ভক্তির বাণী প্রচার করেন, যা আজও মীরার ভজন নামে জনপ্রিয়তার শীর্ষে । তিনি কৃষ্ণপ্রেম প্রচার করতেন । মীরাবাঈ রাজপুত রাজপরিবারের বধূ ছিলেন । রাজপ্রাসাদের জীবন পরিত্যাগ করে তিনি মথুরা বৃন্দাবনে সাধু সন্তের সাথে জীবন অতিবাহিত করেন ।

দাদু : অন্যান্য ভক্তিবাদ প্রচারকের মতো দাদুও হিন্দু-মুসলিম ভেদ ও জাতিভেদ প্রথাকে বিশ্বাস করতেন না । তিনিও মনে করতেন প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায় । দাদুর জন্মস্থান ছিল আমেদাবাদে ।

*****

Related Items

মুঘল যুগে ওলন্দাজ বণিকদের কার্যকলাপ

সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকেই ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা এশীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে থাকে । গোড়ার দিকে এরা পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিল । কিন্তু এরা অচিরেই বুঝতে পারে যে, মশলা ...

মুঘল যুগে পর্তুগিজ বণিকদের কার্যকলাপ

১৪৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করেন, তখন সেই ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষমতা ভারতবাসীর ছিল না । ভাস্কো-দা-গামা মালাবার উপকূলে কালিকট বন্দরে অবতরণ করার পর থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ...

মুঘল যুগে ভারতের বহির্বাণিজ্য

বহির্বিশ্বে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । বিদেশী বণিকরা যেমন ব্যবসার জন্য ভারতে আসত, তেমনই ভারতীয় বণিকেরা, বিশেষত গুজরাটিরা বহির্বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত । ভারত থেকে বস্ত্র, গোল মরিচ, নীল ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি হত । ভারতে আমদানি হত ...

মুঘল যুগে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য

মুঘল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ এবং পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল । তা ছাড়া উন্নত মুদ্রানীতি এবং নগদে বেতন প্রদানের ফলে একদিকে যেমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা ...

মুঘল যুগে ভারতের অকৃষি নির্ভর শিল্প

অকৃষি শিল্প উৎপাদনের একটা বড় অংশ ছিল বিলাসদ্রব্য । সাধারণ মানুষের চাহিদা কম ছিল । বিলাসদ্রব্য নির্মাণের জন্য সরকারি কারখানা বা কর্মশালা ছিল । তবু তার বেশির ভাগ তৈরি হত স্বাধীন কারিগর ও শিল্পীর বাড়িতে । রান্নাবান্না ও ঘর গেরস্থালীর কাজে লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র ...