আকবরের রাজত্ব কাল (The Age of AKbar)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 09/09/2014 - 11:26

আকবরের রাজত্ব কাল - (The Age of AKbar) : (1556-1605)

এক চরম সংকটজনক মুহূর্তে আকবর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন । তখন তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল হিমুকে দমন করা । হিমু ছিলেন চুনার থেকে বাংলা সীমান্ত পর্যন্ত তামাম এলাকার শাসক আদিল শাহের উজির । হিমু আগ্রা অধিকার করে দিল্লির অভিমুখে রওনা হন । এই অবস্থায় আকবরের অভিভাবক বৈরম খান হিমুকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমু পরাজিত হন । এর ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ সম্পূর্ণ হয় । অন্যদিকে দিল্লিতে আফগানি সাম্রাজ্যের পুনরাধিকারের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় । অতঃপর আকবর বৈরাম খানকে অপসৃত করে নিজ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করেন । শুরু হয় মুঘল সাম্রাজ্যের ক্রমোন্নতির ইতিহাস ।

আকবরের রাজ্য জয়ের আদর্শ (Akbar's imperialism) : বাবর মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও তার বিস্তৃতি সাধন করবার সুযোগ পান নি । হুমায়ুনের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটেছিল । দিল্লি সিংহাসন পুনরাধিকার করলেও হুমায়ুন তাকে শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি । পিতা-পিতামহের এই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করেন আকবর । এই কারণেই তাঁকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় । তিনি ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী । তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্বকাল অতিবাহিত হয়েছিল রাজ্য জয় ও সাম্রাজ্য বিস্তারে । তিনি বিশ্বাস করতেন যুদ্ধবিগ্রহ ছিল রাজার অন্যতম প্রধান কর্তব্য । তিনি বলতেন— “রাজার উচিত সবসময়েই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকা । নতুবা প্রতিবেশী রাজারা তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে রুখে দাঁড়াবে”। কিন্তু আকবরের সাম্রাজ্যবাদ নিছক নগ্ন আক্রমণ বা পররাজ্য গ্রাসের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ছিল না । আবুল ফজলের মতে, আকবরের রাজ্যজয় নীতির উদ্দেশ্য ছিল স্বার্থপর ও অত্যাচারী শাসকদের অপসৃত করে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা । সমগ্র ভারত জয় করে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাইকে এক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবার সুমহান আদর্শ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল । তাই লক্ষ করা যায় বিভিন্ন এলাকায় তিনি ভিন্ন ভিন্ন নীতি অনুসরণ করেছিলেন । রাজপুতদের তিনি প্রেম ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে মুসলমানদের হিতাকাঙক্ষী করে তোলেন । আবার দাক্ষিণাত্যে নৈরাজ্য দূর করে তিনি পর্তুগীজদের ক্ষমতা বিস্তারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতি ধর্মীয় গোঁড়ামির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়নি । ভারতবর্ষকে তিনি দার-উল-ইসলাম বা ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করবার কোনো চেষ্টাই করেন নি । হিন্দুরাজ্য দখল করলেও তিনি হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি গ্রহণ করেছিলেন । সর্বোপরি নিছক রাজ্যজয়ের জন্যই তিনি অস্ত্রধারণ করেন নি । সর্বত্র শান্তি, শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে তিনি সত্যিকারের রাজধর্মই পালন করেছিলেন ।

আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার (Expansion of the Mughal Empire) :

(১) উত্তর ভারত : আকবরের সাম্রাজ্যবাদী নীতির সূচনা হয়েছিল বৈরাম খানের জীবদ্দশাতেই । আজমির, মলয় ও গড়কাটাঙ্গা বা গণ্ডোয়ানায় এই সময় অভিযান প্রেরিত হয়েছিল । পরে আকবর রাজপুতানার অধিকাংশ অঞ্চলে নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে বাংলা ও গুজরাট অধিকার করেন ।  আকবর রাজপুতদের সঙ্গে প্রীতি ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হন । তবে মেবারের রাণাপ্রতাপ তাঁর আনুগত্য মানতে অস্বীকার করেন । কিন্তু ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে হলদিঘাটের যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে । মৃত্যুর আগে রাণাপ্রতাপ মেবারের বেশ কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন । রনথম্ভোর ও কালিঞ্জর আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে । এরপর আকবর কাবুল, কাশ্মীর, সিন্ধু, ওড়িশা ও কান্দাহার জয় করে উত্তর ভারত বিজয় সম্পূর্ণ করেন । কিন্তু গুজরাট এবং বিশেষত বাংলায় তাঁর আধিপত্য সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নি । মাঝে মাঝেই জেগে ওঠা বিদ্রোহ তাঁর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । তবে আকবর এইসব বিদ্রোহকে দমন করতে সক্ষমও হয়েছিলেন ।

(২) আকবরের রাজপুত নীতি (Akbar's Policy towards the Rajput) : খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের কাছে পরাজিত হলেও রাজপুতেরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল । আকবর তাঁর প্রখর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দিয়ে রাজপুতদের সাথে মিত্রতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন । তিনি বুঝেছিলেন দেশীয় আফগানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সাম্রাজ্য রক্ষা করতে হলে রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করা একান্ত জরুরি । তাই তিনি রাজপুতদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য সমবেতভাবে চেষ্টা করেন । ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে অম্বরের রাজা বিহারীমল আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং বিহারীমল আকবরের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেন । বিহারীমল, পুত্র ভগবান দাস ও পৌত্র মানসিংহ আগ্রায় আসেন । এরা সবাই দিল্লিতে সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদে আসীন হন । এইভাবে আকবর তিনজন বিশিষ্ট রাজপুতের মিত্রতা অর্জন করেন । যারা পরে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারে আকবরকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছিলেন ।

(৩) দক্ষিণ ভারত : উত্তর ভারতের পর আকবর দক্ষিণ ভারত বিজয়ে মন দেন । দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি দখল করে একটি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনই আকবরের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না । দক্ষিণ ভারতে পর্তুগিজদের শক্তিবৃদ্ধি তাঁর উদ্বেগের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।  তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দুর্বল ও পরস্পর বিবাদমান দক্ষিণী সুলতানদের পক্ষে পর্তুগিজদের আগ্রাসন প্রতিরোধ করা সম্ভবপর নয় । কাজেই দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার না করে তাঁর কোন উপায় ছিল না । তবে তিনি এও উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমগ্র দক্ষিণ ভারত জয় তাঁর পক্ষে অসম্ভব । আকবর প্রথমে এখানে শান্তিপূর্ণ পথে সাম্রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন । কিন্তু খান্দেশ ছাড়া অন্য কোন রাজ্য তাঁর বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি না হওয়ায় তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন । প্রথমে আহমদ নগর ও পরে আসিগড় দখল করেন । পরবর্তী সময়ে দক্ষিণে তাঁর সাম্রাজ্য কৃষ্ণা নদীর উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় । কিন্তু দাক্ষিণাত্যে তাঁর রাজ্য বিজয় নীতি নামে মাত্র সফল হয়েছিল ।

মূল্যায়ন (Evaluation) : দাক্ষিণাত্য, বাংলা ও গুজরাট ছাড়া অন্যত্র আকবরের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল । তাঁর রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য স্থায়িত্ব লাভ করেন । তাঁর কঠোর ব্যক্তিত্ব, সামরিক শক্তি ও উদার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এই স্থায়িত্বের সহায়ক হয়েছিল । তিনি ষোড়শ শতকের ভারতীয় রাজনৈতিক দৈন্য ও অন্তঃসার শূন্যতার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বিগত কয়েক দশক ধরে দেশের সর্বত্র যে বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তা চলছিল, তার অবসান করতে হলে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী নীতি অপরিহার্য ছিল । কিন্তু নিছক বাহুবল কোনো সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধান করতে পারে না । তাই এই স্থায়িত্ব বিধানের জন্য তিনি একটি দক্ষ শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন এবং ঐক্য ও সংহতির বন্ধনে সমস্ত ভারতবাসীকে এক সূত্রে আবদ্ধ করে মুঘল রাজশক্তিকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ।

*****

Related Items

কুষাণ সাম্রাজ্য (Kushana Dynasty)

মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর যে সমস্ত বৈদেশিক জাতি ভারতে অনুপ্রবেশ করে ছিল, তাদের মধ্যে কুষাণরাই ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য । মৌর্যদের পর তারাই প্রথম একটি বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল । কুষাণদের ভারতে প্রবেশের ইতিহাস অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক । ...

মগধের উত্থান (Rise of Magadha)

পরপর চারটি শক্তিশালী রাজবংশের ধারবাহিক রাজত্ব মগধের উত্থান সম্ভব করেছিল। সেই চারটি রাজবংশ হল- (১) হর্ষঙ্ক বংশ, (২) শিশুনাগ বংশ, (৩) নন্দ বংশ ও (৪) মৌর্য বংশ। মগধের উত্থানের কারণ , মৌর্যবংশ, মৌর্য শাসনব্যবস্থা, অশোক, কলিঙ্গযুদ্ধ জয় ...

ষোড়শ মহাজনপদ (Sixteen Mahajanapadas)

খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারত ঐক্যবদ্ধ ছিল না । মূলত বৌদ্ধ ও জৈন শাস্ত্র থেকে জানতে পারা যায় যে, ওই সময় ভারত ষোলটি রাজ্য বা মহাজনপদে বিভক্ত ছিল । যথা—অঙ্গ (বর্তমান পূর্ব বিহারের মুঙ্গের ও ভাগলপুর), মগধ (বর্তমান দক্ষিণ বিহারের পাটনা, গয়া এবং সাহাবাদের কিছু অংশ), ...

রাজশক্তির উত্থান (Growth of kingship)

প্রথম দিকে আর্যরা ভরত, যদু, অনু, পুরু, সঞ্জয় প্রভৃতি বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। পশুচারণ ও কৃষিজমি অধিকার নিয়ে প্রায়ই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকত। তখনকার দিনে রাজারা ছিল যোদ্ধাদের নেতা । ঋক্‌বেদে দশ রাজার যুদ্ধ থেকে এই যুদ্ধ ...

আধুনিক যুগের ঐতিহাসিক উপাদান

আধুনিক যুগের ইতিহাস রচনার জন্য ঐতিহাসিক উপাদানের কোনো অভাব নেই । লেখ্যাগারে সঞ্চিত সরকারি নথিপত্র, বিভিন্ন বিদেশী, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাগজপত্র, সংবাদ পত্র ও সাময়িক পত্র, শাসক ও সরকারি কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের দিনপঞ্জী ...