মাতৃভাষা ও শিক্ষা : একটি অনুভব...

Submitted by Anonymous (not verified) on Tue, 06/14/2011 - 21:24

মাতৃভাষা ও শিক্ষা : একটি অনুভব...

 

   ড: হরষিত মন্ডল
    মনিরামপুর মহেন্দ্র বালক বিদ্যালয়,
    উত্তর ২৪ পরগনা

 

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ব্যতীত কোনো জাতির আলোর পথে উদ্ভাসিত হবার কোনো পথ নেই, কেননা মাতৃভাষাই হলো গতি ও গতিধারা যেখানে সুদূরপ্রসারী শিক্ষার উন্নতি আছে, আছে মহত্বের মহান দিশা। বিশেষত নবজাগরণ তথা ঐতিহাসিক ধারাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে আধুনিকতায় লালিত হয়ে কোনো ভাষা পরিমন্ডিত হ্য়, সে মাতৃভাষা। নিজের ঘরকে জেনে, তারপর অপরের ঘরকে জানতে হয়।
সেজন্য, কোনো ব্যক্তি মাতৃভাষায় সুদক্ষ না হলে অন্য ভাষায় সে জ্ঞানী হতে পারে না। শক্তির মূল সুর মাতৃভাষার মধ্যেই নিমজ্জিত আছে, যেখানে জ্ঞানালোকের অনন্ত সাগর আছে, আছে সুললিত সমৃদ্ধি।
শিক্ষাকে গনতন্ত্রীকরণ করতে হলে অনন্য উচ্চারণে মাতৃভাষাকে গ্রহন করতেই হবে, কেন-না মাতৃভাষাই হল সরল সত্যধারা। শিশু জন্মগ্রহনের পর থেকেই মায়ের কাছে লালিত পালিত হয়, সুতরাং মায়ের ভাষাই সে প্রথম শেখে, মায়ের মুখনিঃসৃত বানীতেই সে পুষ্ট হয়, হয় সমূহ সমৃদ্ধ।মাতৃভাষার মধ্যেই শিক্ষাবিস্তারের বিশ্বস্ততা ও নির্ভরতা লুকিয়ে আছে।সুতরাং মায়ের গুরুত্ব শিক্ষাপ্রসারে আপরিসীম। বলা চলে —
"A mother's love is indeed the golden link that binds youth to age; and he is still but a child, however time may have furrowed his cheek, or silvered his brow, who can yet recall, with a softened heart, the fond devotion or the gentle chidings of the best friend that God ever gives us."
………………….Christian Nestell Bovee.

 

জীবন ও জগতের প্রাত্যহিক প্রবাহ মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।জীবনের নান্দনিক অভিব্যক্তি সুখ, দুঃখ, সৌন্দর্যবর্ণন, সাবলীল ভাব-বিন্যাস, সবই মাতৃভাষার মাধ্যমে সমান্তরালে সম্পৃক্ত হয়, যেখানে নির্মলতা তথা কুয়াশাময় বর্ননও একীভূত হয়। মূলত মাতৃভাষা স্রোতস্বিনী নদীর মতো যেখানে সঙ্গত সঙ্গীত আছে, আছে স্বাভাবিকতাসমূহ সারসতা। বলা যায় –
" আমরা যেখানে জীবন নির্বাহ করিব আমাদের শিক্ষা তার আনুপতিক নহে, আমরা যে গৃহে আমৃত্যুকাল বাস করিব সে গৃহের উন্নত চিত্র আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নাই, যে সমাজের মধ্যে আমাদিগকে জন্ম স্থাপন করিতেই হইবে সেই সমাজের কোন উচ্চ আদর্শ আমাদের নতূন শিক্ষিত সাহিত্যের মধ্যে লাভ করি না, আমাদের পিতামাতা-আমাদের সুহৃৎবন্ধু- আমাদের ভ্রাতাভগ্নীকে তাহার মধ্যে দখি না, আমাদের দৈন্দিন জীবনের কার্যকলাপ তাহার বর্ননার মধ্যে কোনো স্থান পায় না, আমাদের আকাশ এবং পৃথিবী, আমাদের নির্মল প্রভাত এবং সুন্দর সন্ধ্যা --- আমাদের পরিপূর্ণ শস্যক্ষেত্র এবং দেশলক্ষ্মী স্রোতস্বিনীর কোনো সংগীত তাহার মধ্যে ধ্বনিত হয় না, তখন বুঝিতে পারি আমাদের শিক্ষার সহিত আমাদের জীবনের তেমন নিবিড় মিলন হইবার কোনো স্বাভাবিক সম্ভাবনা নাই। উভয়ের মাঝখানে একটা ব্যবধান থাকিবেই থাকবে; কিন্তু এ মিলন কে সাধন করিতে পারে?
বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য।"
জীবন ও জগতের প্রাত্যহিক প্রবাহ মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।জীবনের নান্দনিক অভিব্যক্তি সুখ, দুঃখ, সৌন্দর্যবর্ণন, সাবলীল ভাব-বিন্যাস, সবই মাতৃভাষার মাধ্যমে সমান্তরালে সম্পৃক্ত হয়, যেখানে নির্মলতা তথা কুয়াশাময় বর্ননও একীভূত হয়। মূলত মাতৃভাষা স্রোতস্বিনী নদীর মতো যেখানে সঙ্গত সঙ্গীত আছে, আছে স্বাভাবিকতাসমূহ সারসতা। বলা যায় –
" আমরা যেখানে জীবন নির্বাহ করিব আমাদের শিক্ষা তার আনুপতিক নহে, আমরা যে গৃহে আমৃত্যুকাল বাস করিব সে গৃহের উন্নত চিত্র আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নাই, যে সমাজের মধ্যে     আমাদিগকে জন্ম স্থাপন করিতেই হইবে সেই সমাজের কোন উচ্চ আদর্শ আমাদের নতূন শিক্ষিত সাহিত্যের মধ্যে লাভ করি না, আমাদের পিতামাতা-আমাদের সুহৃৎবন্ধু- আমাদের ভ্রাতাভগ্নীকে তাহার মধ্যে দখি না, আমাদের দৈন্দিন জীবনের কার্যকলাপ তাহার বর্ননার মধ্যে কোনো স্থান পায় না, আমাদের আকাশ এবং পৃথিবী, আমাদের নির্মল প্রভাত এবং সুন্দর সন্ধ্যা --- আমাদের পরিপূর্ণ শস্যক্ষেত্র এবং দেশলক্ষ্মী স্রোতস্বিনীর কোনো সংগীত তাহার মধ্যে ধ্বনিত হয় না, তখন বুঝিতে পারি আমাদের শিক্ষার সহিত আমাদের জীবনের তেমন নিবিড় মিলন হইবার কোনো স্বাভাবিক সম্ভাবনা নাই। উভয়ের মাঝখানে একটা ব্যবধান থাকিবেই থাকবে; কিন্তু এ মিলন কে সাধন করিতে পারে?
    বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য।"

    মনন ও চেতনার দলিলকে বিকশিত করতে হলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই করা সমুচিত। সর্বতো ভাষা তথা মাতৃভাষার মাধ্যমেই করা সমুচিত। সর্বতো ভাষা তথা মাতৃভাষার সুরম্য সন্নিধান থাকে,থাকে জ্ঞানের ছন্দময় সহাবস্থান। বলা চলে ---
    "Language is properly the servant of thought, but not frequently becomes its master. The conceptions of a feeble winter are greatly modified by his style; a man of vigorous powers makes his style bend to his conceptions-a fact compatible enough with the acknowledgment of Dryden, that a rhyme had often helped him to an idea."
    বিশেষত কোনো মৌলিক গবেষণা ও মৌলিক কোনো কিছু উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে মাতৃভাষাই অনন্য, কেননা মানুষ মাতৃভাষার মাধ্যমেই চিন্তার বিকাশ ও বিস্তার ঘটাতে পারে। আন্যাধারে পুস্তক-শিক্ষা মনের মাধুরিতেই অনবদ্য হয়ে ওঠে। সেই মাতৃভাষাই পুষ্ট হয়, পরিবর্ধিত, পরিশীলিত হয়। বলা যায়---
    "The attempt to make boys moral...by the teaching of moral...text books is a vanity and delusion, precisely because the heart is not the and so instruct to mind does not necessarily improve the heart."
    বস্তুত মাতৃভাষার মাধ্যমেই ভাবমন্থন, ভাবের আদানপ্রদান সরলভাবে হয় ; আর বিদেশী ভাষার মাধ্যমে, কোনো বক্তব্য-বিন্যাস হোঁচট খায়, বন্ধুর পথে চলতে থাকে, যেখানে মৌলিক ভাবনা একটা স্তর অবধি পৌঁছুতে পারে, সামগ্রিক হতে পারে না । বলা যায় ...... " যে ভাষায় শিশুর মুখের বুলি ফোটে, সে ভাষা তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে , তার শোনিত ধারার সঙ্গে মিশে থাকে। মাতৃভাষার ভাব প্রকাশ তার জন্মগত আধিকার। সেই ভাষাতেই তার চিন্তামুক্তি ঘটা সম্ভব । সোভিয়েত রাশিয়ার আজ যে বিজ্ঞান সাধনায় চরম সমুন্নতি , তার মূলে রয়েছে তার মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার আয়োজন। বিজ্ঞানচর্চা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতে, আমাদের জীবনের সকল ভাব-চিন্তা, আশা-আকাঙ্খার সঠিক রূপায়ণ বাংলা ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। যে ভাষায় মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবিন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যের দিক্পালগন তাঁদের প্রতিভার সর্বশ্রষ্ঠ উপাচার দিয়ে নৈবেদ্য রচনা করে গিয়েছেন, তা কখনই ব্যর্থ হতে পারে না।"
মনকে স্বাস্থ্যয়িত করতে মাতৃভাষার গুরুত্ব আপরিহার্য কেননা কাঙ্খিত সব সংস্কার ও অধ্যায় সুপরিকল্পিত চিন্তনের মাধ্যমেই সম্ভব। সে সুধু মাতৃভাষাই দিতে পারে। ছাত্রদের শিক্ষারক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে গেলে মাতৃভাষার মাধ্যমই শিক্ষার আধুনিকীকরন ঘটাটে হবে। রবীন্দ্রনাথ তাই তো পূর্ণপ্রত্যয়ে বলেছেন-------
"……. the student can have a vision of the goodness of learning Where there is no need of external objects, there the mind also elevates and grows into completeness."
বিদেশী ভাষা থেকে উন্নত চিন্তা-ভাবনা গ্রহন করে মাতৃভাষাকে সম্বৃদ্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু তা হৃদয়াবেগকে মন্থিত ও সুললিত করতে পারে না কখনো। বিদেশী ভাষা জড়তাগ্রস্থ স্থবির অচলায়তনকে বিধ্বস্ত করার এক জঙ্গমশক্তি। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি সমাজনীতিকে সাবলীল ধারায় মোহনাগামী করতে বিদেশী ভাষার কোনো ভূমিকা থাকে না। মাতৃভাষারই সেখানে সামগ্রিক দ্যোতনা। বলা চলে---
"....আহ্বান করতে হবে মাতৃভাষাকে দেশব্যাপী দুঃখ-যন্ত্রণা ও দারিদ্রের সিংহাসনে আজ আমাদের অবহেলিত মাতৃভাষাকে সসম্মানে অভিষিক্ত করতে হবে। কারণ সাতসমুদ্র তেরো নদীর পারের ভাষা দিয়ে আর যাই হোক, কোনোদিন কোন জাতির মাতৃপূজার বোধনমন্ত্র কখনই রচিত হতে পারে না।"
পূর্ণতার সম্যক ধ্বনিই হলো মাতৃভাষা যেখানে মনের জোরাল ও     রসালো সমাবর্তন থাকে। থাকে বর্নমালার সমূহ সারসত্তা। কবি তাই তো লেখেন---
    "..................
    তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে কি থাকে আমার?
    উনিশ শো' বাহান্নর দারুন রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
    বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী ।
    সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
    কত নোংরা হাতে হিংস্রতা ধেয়ে আসে।
    এখন তোমাকে নিয়ে নোংরার নোংরামি,
    এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!
    তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
    বর্নমালা, আমার দুঃখিনী বর্নমালা।"
    অনুভূতির সার্থক শিল্পসুষমামন্ডিত রূপ পরিলক্ষিত হয় মাতৃভাষাতেই, যেখানে সব আবেগ, সৌন্দর্য গভীর ভালোবাসা হয়ে উৎসারিত হয়, কেন-না মাতৃমন্ডলই হলো সুষম শস্যাধার, আন্দোলনের প্রোথিত ধারা। এখহানেই আমাদের প্রিয় মমত্ববোধ মগ্ন-মন্থনে হেঁটে যায় সযত্নে বহুদূর। আবর্তনে আমাদের প্রতিদিনেই জীবনদর্শন বর্ণার আদলে ঘরগঘস্থলীর ছন্দে একীভূত।" কবি লেখেন -----
    " বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকোনো উঠোনে ঝরে
    রৌদ, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন। বাংলাভাষা
    উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে
    উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর
    বাঁকে, বাঁকে ,নদীও নর্তকী হয়।
    ...........................................।
    ঘুম পড়ানিয়া ছড়া কোন সে সুদূরে .......
    ..... আর একুশের প্রথম ফেরি অলৌকিক ভোর।"
    প্রয়োগ ও সাফল্যের দিক থেকেও মাতৃভাষার অগ্রসরতা অবশ্য গ্রহনীয়। জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় জীবন --- এই দুয়ের মধ্যে সুমিষ্ট সম্পর্ক স্থাপিত হোক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা দিয়েই শেষ করি----
    " মাতৃভাষার অপবাদ দূর হোক, যুগ শিক্ষার উদ্বেল ধারা বাঙালী চিত্তের শুষ্ক নদীর রিক্ত পথে বান ডাকিয়ে বয়ে যাক, দুই কূল জাগুক পূর্ণ চেতনায়, ঘাটে ঘাটে উঠুক আনন্দ ধ্বনি।" সেই আনন্দধ্বনিতে আমরা গতিশীল হই, হই ক্রমোন্নতির এক একটি মূর্ত প্রতীক, কেন-না সমস্ত আবেদন, নিবেদন, পূর্ণতা ও প্রাপ্তির সর্বব্যাপী প্রসার ও প্রভাব মাতৃভাষাই আছে, যেখানে শিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট বীজ লুক্কায়িত আছে।

 

 

 

 

 

 

 

Tags

Comments

Related Items